দুনিয়াবিমুখতা


ইসলামী ইতিহাসে সফল চার বাদশাহর একজন হওয়ার দাবীদার আব্বাসী খলিফা আবু জাফর আলমানসুর (জন্ম : ৯৫ মৃত্যু : ১৫৭ হিজরি; খেলাফতকাল : ১৩৭ হিজরি থেকে মৃত্যু অবধি) যুগশ্রেষ্ঠ চার আলেমের কোন একজনকে প্রধান বিচারপতি বানানোর মনস্থ করলেন। ১. ইমাম আবু হানিফা রহ. (জন্ম : ৮০ মৃত্যু : ১৪৮ হিজরি), ২. হাদিস সম্রাট সুফিয়ান সাওরী রহ. (জন্ম : ৯৭ মৃত্যু : ১৬১ হিজরি), ৩. হাদিসের ইমাম মিসআর বিন কিদাম আলহিলালী রহ. (মৃত্যু : ১৫৩ হিজরি), ৪. কোন কোন কিতাবে চতুর্থজনের নাম কাজী শুরাই উল্লেখ থাকলেও প্রসিদ্ধ কাজীউল কুজাত কাজী শুরাই ইবনুল হারেস যে নন তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। 
সকলেই বাদশাহর ডাকে সাড়া দিতে বাধ্য ছিলেন। পথিমধ্যে পরামর্শ শুরু হল : কোন না কোন বাহানায় এ মুসিবত থেকে পরিত্রাণ পেতেই হবে। ইমাম আবু হানিফা রহ. সিদ্ধান্ত দিলেন, আমি কোন একটি বাহানা করে বেঁচে যাব। মিসআর পাগল সাজবে। সুফিয়ান পলায়ন করবে। শুরাই বিচারকের পদ গ্রহণ করবে। কথা মতো- সুফিয়ান সাওরী রহ. রাস্তা থেকে পালিয়ে গেলেন। একটি নৌকায় গিয়ে জানের নিরাপত্তা চাইলেন। বললেন, ‘বাদশাহর লোকেরা আমার গর্দান উড়িয়ে দেওয়ার জন্য খুঁজে বেরাচ্ছে।’ তিনি “যাকে বিচারক বানানো হল তাকে যেন ছুরিবিহিন জবাই করে দেওয়া হল” এই হাদিসের আলোকে কথাটি বলেছেন। হাদিসটি তিরমিজিতে ১২৪৭, আবু দাউদে ৩১০০, ইবনে মাজায় ২২৯৯ নম্বরেসহ অন্য কিতাবেও বর্ণিত আছে। বিপদগ্রস্ত জেনে মাঝিরা নৌকায় লুকিয়ে রাখল। বাকি তিনজন খলিফা মনসুরের দরবারে উপস্থিত হলেন। 
বাদশাহ প্রথমে ইমাম আবু হানিফা রহ.কে প্রধান বিচারকের পদ গ্রহণের প্রস্তাব দিল। ইমাম সাহেব উত্তর দিলেন, ‘আমি আরব বংশোদ্ভুত নই; বরং আমার পূর্ব পুরুষ আরবদের গোলাম ছিল। আরবের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ আমার ফয়সালা কীভাবে মেনে নিবেন?’
: ‘এ পদে বংশের কোন আবশ্যকতা নেই; ইলম প্রয়োজন। আপনি যুগের শ্রেষ্ঠ আলেম।’
: ‘আমি বিচারক হওয়ার যোগ্য নই।’
: ‘আপনার দাবি সত্য নয়। আমার নিশ্চিত জানা আছে, আপনি এ পদের সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি।’
: ‘তাহলে তো আমি মিথ্যুক। সুতরাং আমি সত্যবাদী হলে তো- অযোগ্য। আর মিথ্যাবাদী হলে- একজন মিথ্যুক তো কখনোই কাজী হতে পারে না।’
এই বাহানায় ইমাম আজম রহ. নিষ্কৃতি লাভ করলেন। ইমাম আজম রহ. নিজেকে ‘অযোগ্য’ বলেছিলেন একটি মূলনীতির আলোকে। ইসলামী রাষ্ট্রের মূলনীতি হল, আইন প্রণয়ন ও আইন বাস্তবায়নকারী অথরিটি হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও স্বাধীন। ইমামে আজম আবু হানিফা রহ. আইন প্রণয়নের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন হেতু ইসলামী রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে তিনি শুধু প্রধান বিচারপতি নন; বরং আইন বাস্তবায়নকারী অথরিটির যে কোন পদের অযোগ্য ছিলেন। চিন্তাশীল জ্ঞানী পাঠকবর্গ একটু চিন্তা করুন, যদি এই মূলনীতি আজও পালন করা হয়- দেশের শান্তি শৃঙ্খলা সুবিচার কীরূপ হবে?
এরপর মিসআর বিন কিদাম রহ.-এর পালা আসলে, পাগলামী প্রকাশের উদ্দেশ্যে- খলিফার হাত ধরে ফেললেন। বলতে শুরু করলেন, ‘তুমি কেমন আছ? তোমার ছেলেপুলে কেমন আছে? তোমার বেগম সাহেবা ভালো তো?’ পরিস্থিতির আকস্মিকতায় খলিফা মানসুর আদেশ দিল, ‘এ তো বড্ড পাগল। দ্রুত একে বাইরে নিয়ে যাও।’ শুরাই রহ.কে বলা হল, ‘আপনি প্রধান বিচারকের পদ গ্রহণ করুন।’ তিনি বললেন, ‘আমি ব্যবসায়ী মানুষ। তাছাড়া আমার ব্রেনও অতি দুর্বল হয়ে পড়েছে।’ খলিফা বলল, ‘কোন সমস্যা নেই। মস্তিষ্কের শক্তিবর্ধক ঔষধ ও খাবার দ্বারা আপনার চিকিৎসা করা হবে। আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন।’ পরিশেষে কাজী শুরাই রহ. পদগ্রহণে বাধ্য হলেন।
বর্ণিত আছে, ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর এহেন বুদ্ধিদীপ্ত জবাবে নিরুত্তর হয়ে বাদশাহ অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে ইমামকে বন্দি করার নির্দেশ দেয়। ঐ বন্দিশালাতেই নির্যাতনের প্রচণ্ডতার একপর্যায়ে মহান মাওলার সান্নিধ্যের সফর শুরু হয়ে যায়। কতক বর্ণনা মতে, প্রতিনিয়ত চাবুকাঘাত করেও বিচারপতি পদের জন্য রাজি করানো সম্ভব না হওয়ায় ক্রোধের চূড়ান্ত উন্মত্তায় খলিফা বিষপ্রয়োগে গুপ্ত হত্যার নির্দেশ দেয় এবং তাই কার্যকর করা হয়। 
সুবহানাল্লাহ! কেমন ছিল তাদের দুনিয়াবিমুখতা। দুনিয়ার পদ-পদবী থেকে বাঁচার জন্য কেমন উদ্বিগ্ন ছিলেন। আর আমরা? আজ আমরা লোভ লালসার এমন শিকারে পরিণত হয়েছি- নিজের স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে দুনিয়াদারদের তোষামোদে আত্মতৃপ্তি যেন খুঁজে পাই। আল্লাহ রব্বুল আলামিনকে পেতে হলে সর্বান্তকরণে দুনিয়াকে বিসর্জন দিতে হবে। অন্যথায় সমাজকে ধোঁকা দিয়ে বড় ওলী বুজুর্গ সাজা যাবে; কিন্তু মাওলা পাকের সান্নিধ্যের অপার্থিব অনাবিল প্রশান্তি পাওয়া যাবে না।

মন্তব্যসমূহ

  1. মাশাআল্লাহ। তথ্যবহুল খুবই গুরুত্বপপূর্ণ আলোচনা।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. শুধু তথ্য নয়; নসিহতটা যেন গ্রহণ করতে পারি দোয়া চাই। কমেন্টের জন্য শুকরিয়া।

      মুছুন
    2. আল্লাহ হুজুরকে নেক হায়াত দান করুন,আমিন

      মুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

“সকাল বেলার ধনীরে তুই ফকির সন্ধ্যা বেলা”

দুরুদে সালাত শব্দ থাকা আবশ্যক সালামে থাকবে س ل م

দুটি রহস্যান্মোচন