আহমাদ খজরুইয়াহ ও দুটি গল্প
হজরত শেখ আবু হামেদ আহমাদ খজরুইয়াহ বলখী খোরাসানী রহ. (মৃত্যু : ২৪০ হি.) হিজরি তৃতীয় শতাব্দীর অতি উচ্চ মাপের বুজুর্গ ছিলেন। তখন ছিল আব্বাসীয় খিলাফতের দশম খলিফা জা‘ফর ইবনে মুহাম্মদ আলমু‘তাসিম আলমুতাওয়াক্কিল ‘আলাল্লাহ’র (জন্ম : মার্চ ৮২২ ঈ. মৃত্যু : ১১ ডিসেম্বর ৮৬১ ঈ.) সময়কাল। হজরত হাতেমে আসম রহ. (মৃত্যু : ২৩৭ হি.) ছিলেন তাঁর পীর। তবে আবু ইয়াজিদ আলবোস্তামী (জন্ম : ১৮৮ হি. মৃত্যু : ২৬১ হি.) ও আবু তুরাব আননাখশাবী (মৃত্যু : ২৪৫ হি.) রহ. এই দুই বুজুর্গ থেকেও তিনি তাসাউফের দীক্ষা গ্রহণ করেছেন।
হজরত আহমাদ খজরুইয়াহ রহ. নিশাপুর অবস্থানকালে শায়েখ ইয়াহইয়া ইবনে মা‘আজ রাজী (মৃত্যু : ২৫৮ হি./ নিশাপুর) রহ. নিশাপুর আগমন করেন। শায়েখ খজরুইয়াহ তাঁর স্ত্রী হজরত ফাতেমা রহ. (যিনি নিজেও রাজকন্যা হওয়া সত্ত্বেও দুনিয়াবিমুখ বড় আবেদা ছিলেন) এর সাথে শায়েখ ইয়াহইয়াকে দাওয়াত দেওয়ার মানসে পরামর্শ করলেন। মেহমানদারির জন্য প্রয়োজনীয় আসবাবের তালিকায় তিনি বিশটি গাধার কথাও বললেন। শায়েখ জিজ্ঞাসা করলেন, অন্যসব তো ঠিক আছে; কিন্তু গাধা দিয়ে কী হবে? উত্তরে বললেন, “যখন একজন দানশীল আরেকজন দানশীলের বাড়িতে মেহমান হয় তখন উক্ত শহরের কুকুরগুলোরও অধিকার থাকে উত্তম খানাপিনার।”
হজরত আহমাদ খজরুইয়াহ রহ. একবার কোন এক বুজুর্গের দরবারে গেলেন। তাঁর গায়ে ছিল পুরোনো জীর্ণ পোশাক। ফকিরী বেশ ভূষা দেখে দরবারের লোকেরা পাত্তা দিল না; একরূপ তাচ্ছিল্যভরা দৃষ্টিতে তাকে দেখতে লাগল। ইত্যবসরে বালতিটি কূপে পড়ে গেলে উঠানোর মতো কোন উপায় না থাকায় লোকেরা খানকার শায়খের নিকট দু‘আর আরজি জানাল; যেন বালতি উপরে উঠে আসে। এমন অপ্রত্যাশিত দু‘আর আবেদনে শায়েখ নিশ্চুপ রইলেন। আহমাদ খজরুইয়াহ রহ. বললেন, অনুমতি হলে আমি দু‘আ করতে পারি। অনুমতি প্রাপ্ত হয়ে তিনি দু‘আ করার সাথে সাথে গভীর কূপের তল থেকে নিজে নিজে বালতি উপরে উঠে আসল। পরিস্থিতি দেখে সকলেই তাঁকে বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখতে লাগল। আহমাদ খজরুইয়াহ রহ. উক্ত শায়েখকে বললেন, মুরিদগণকে সাবধান করুন, কোন মুসাফিরকে যেন হেয় জ্ঞান না করে।
শিক্ষা : যাদের উত্তরসূরি দাবি করে গর্ববোধ করি। যাদের মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখি। তারা তো কুকুরের জন্য বিশটি গাধার প্রস্তাব করেছেন আর আমরা? নিজেদের চারপাশে গরিব দুঃখী যে লোকেরা রয়েছে, তাদেরকে যেন দেখেও দেখি না। আল্লাহকে পেতে হলে দিলকে অনেক উদার প্রশস্ত করতে হবে। আমার যা আছে, যতটুকু আছে তাতেই যদি আরো দশজনকে শরিক করি, আমার জন্য বরকতের দরজা খুলে যাবে।
অতীত বুজুর্গদের জীবনী যতই পাঠ করবেন- সকলের বেলায়ই পাবেন অতি সাদাসিধা পোশাকের কথা। এমনকি ‘সুফি’ বলে নামকরণের কারণ হিসেবে পাওয়া যায়, সে যুগের নিম্ন মানের পোশাক হিসেবে বুজুর্গরা পশম দ্বারা তৈরি পোশাকাদি ব্যবহার করতেন। পশমকে আরবিতে বলা হয় ‘সুফ’; সে অর্থে সুফি মানে পশমের পোশাক পরিধানকারী ব্যক্তি। যেহেতু বুজুর্গরা প্রায় সকলেই পশমের পোশাক ব্যবহার করতেন তাই তাদের নাম হয়ে গিয়েছে ‘সুফি’। যদিও অনেকেই আবার এ মতকে কাল্পনিক উল্লেখ করে বলেছেন ‘সফাউল কলব’ (আত্মিক পরিশুদ্ধি) শব্দ থেকে পরিশুদ্ধ আত্মার অধিকারী হিসেবে তাদেরকে সুফি বলা হত।
সুফি-সাধক হতে আমারও মন চায়; কিন্তু চরম দুনিয়াদারদের পোশাকপ্রীতির ন্যায় আমিও পোশাকপ্রীতি নামক মারাত্মক আত্মিক ক্যান্সারে আক্রান্ত। নিজের চিকিৎসা করানোর পরিবর্তে কেউ কিছু বললে তাদের বরং অনাধুনিক মনে করি। ইমাম মালেক রহ. বলেছেন, ‘এ উম্মতের প্রথম যুগের লোকেরা যে পথ-পন্থায় উন্নতি লাভ করেছে/ শেষ যুগের লোকেরাও উন্নতি লাভ করতে হলে সে পথ-পন্থাই অবলম্বন করতে হবে।’
শেখ সা‘দী (জন্ম : ১২১০ ঈ. মৃত্যু : ১২৯১/৯২ ঈ.) রহ.’র পকেটে খাবার ঢুকানোর গল্প হয়ত জেনে থাকবেন। কোন এক বাদশাহর আমন্ত্রণে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে মুসাফির হিসেবে এক আমিরের (ধনী লোক) মেহমান হলেন। গায়ে ছিল অতি সাদাসিধা পোশাক। আমিরও খুব সাদাসিধাভাবেই অভাবগ্রস্ত সাহায্যপ্রার্থীদের ন্যায় মেহমানদারী করলেন। বাদশাহী সম্মাননা গ্রহণ করে ফিরার সময় গায়ে ছিল বাদশাহের হাদিয়া দেওয়া রাজকীয় পোশাক। এবারও ঐ আমিরের বাড়িতেই মেহমান হলেন। বেচারা আমির তো এত বড় মেহমান পেয়ে যারপরনাই ব্যস্ত। দীর্ঘ সময় ব্যয়ে রন্ধনকৃত উত্তমসব খাবার দস্তরখানায় সাজিয়ে শেখ সা‘দী রহ.কে দস্তরে আমন্ত্রণ জানানো হলে তিনি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে খাবারদাবার মুখে দেওয়ার পরিবর্তে পকেটে পুরতে লাগলেন। সকলে তো হতবাক! আমির বেচারা কারণ জানতে চাইলে গতবারের ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিলেন। লজ্জায়-অনুশোচনায় একাকার হয়ে পায়ে লুটিয়ে পড়লো মেজবানসকলে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন