উচ্ছ্বাস নহে চাহি দাসত্ব
এ পৃথিবীতে আমার আগমন বান্দা হিসেবে। বান্দা মানে গোলাম বা দাস। নিজের কোন প্রকার ইচ্ছা বা পরিকল্পনার ঊর্ধ্বে উঠে মনিবের হুকুম অনুপুঙ্খ প্রতিপালন করাই গোলামের দায়িত্ব। আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমার মনিব; আমি তাঁর গোলাম। মনিবের হুকুমের বাইরে আমার কোন ইচ্ছা কোন পরিকল্পনা নেই। নিজস্ব বলতেই কিছু নেই। আমার ইচ্ছা, আমার পরিকল্পনা সম্পূর্ণ কোরবান মহান মনিবের হুকুমের ওপর। তাঁর সন্তুষ্টি আমার জীবনের একমাত্র কাম্য। এ সন্তুষ্টির লক্ষ্যে আমি সবকিছু বিসর্জন দিতে সদা প্রস্তুত।
জীবনের প্রতিটি দিকের ন্যায় কোন সময় বা স্থানকে বিশেষ গুরুত্ব বা সম্মান দেওয়ার ক্ষেত্রেও আমি আমার ইচ্ছা-পরিকল্পনা-আবেগ-উচ্ছ্বাসের দাস নই। আমি আল্লাহ রব্বুল আলামিনের দাস। তিনি আমার মনিব। তাঁর হুকুমের বাইরে, তাঁর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের বাইরে আমার কোন করণীয় নেই।
إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِندَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ
(তরজমা) “নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন হইতেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট মাস গণনায় মাস বারটি; তন্মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ।” [সুরা তাওবা : ৩৬] আয়াতে জিলকদ, জিলহজ, মুহার্রম ও রজব এই চার মাস উদ্দেশ্য। এছাড়া হাদিসেও এ চার মাসের বিশেষ সম্মান প্রমাণিত। তাই গোলাম হিসেবে, বান্দা ও দাস হিসেবে আমার নিকটও এ চার মাস সম্মানিত। বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন। যদি আমার ইচ্ছা জাগে, কোন মাসকে বা দিনকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার- আমার এহেন পরিকল্পনা গ্রহণের পূর্বে দেখতে হবে এ ব্যাপারে আমার মনিবের পক্ষ থেকে কী নির্দেশনা রয়েছে।
عن أبي هريرة رضي الله عنه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال
"لا تخصوا ليلة الجمعة بقيام من بين الليالي، ولا تخصوا يوم الجمعة بصيام من بين الأيام، إلا أن يكون في صوم يصومه أحدكم".
“রাতসমূহের মধ্য থেকে শুধু জুমার রাতকে (নফল) ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করো না। দিনসমূহের মধ্য থেকে শুধু জুমার দিনকে (নফল) রোজার জন্য নির্দিষ্ট করো না। তবে ...” রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বাণী ঘোষণা করে যে, দিন-রাত-সপ্তাহ-মাসকে শরিয়তের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্মান-গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তারচেয়ে বেশি সম্মান-গুরুত্ব দেওয়ার কোন সুযোগ নেই; বরং কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। যদিও শরিয়তে জুমার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে কিন্তু তা যেন সীমা অতিক্রম না করে তা-ই এ হাদিসের প্রতিপাদ্য।
ইসলাম মুসলমানদের বিশেষ দু’টি ইবাদতের সাথে সংশ্লিষ্ট করে দু’টি দিবস দান করেছে। একমাস রোজা-তারাবিহ-তেলোয়াত-অধিক পরিমাণে অন্যান্য নফল আমলের পর বিশেষ-সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা এবং আল্লাহ রব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রাপ্তির আনন্দ ঈদুল ফিতর। মহান প্রভুর উদ্দেশ্যে পশু কোরবানির মাধ্যমে নিজের ইবাদত-হায়াত-মউত-সবকিছু একমাত্র সে মহান সত্তার জন্য নিবেদিত- এ কথা প্রকাশের সুযোগ এবং সারা দুনিয়ার মুসলমানের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বাইতুল্লাহ যিয়ারতে একত্রিত হয়েছে- এ আনন্দ হল ঈদুল আযহা। এ দু’টি দিবসের বাইরে যে কোন উপলক্ষে কোন দিবস পালনের সুযোগ ইসলামে নেই।
কারো জন্ম-মৃত্যুর সাথে সংশ্লিষ্ট কোন দিবস উদযাপন হজরত আদম আ. থেকে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত কোন নবী কোন রসুল পালন করেননি। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন, সলফে সালেহীন কারো জীবনেই জন্ম বা মৃত্যু দিবস তথা অন্য কোন দিবস পালনের নজির নেই। তবে খ্রিস্টানগণ ২৫ ডিসেম্বর ঈসা আ.-এর জন্মদিন, হিন্দুরা ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষে বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের জন্মদিন হিসেবে জন্মাষ্টমী পালন করে থাকে।
عن ابن عمر - رضي الله عنهما - : أنَّ النبيَّ - صلى الله عليه وسلم - قال:
بُعِثْتُ بين يَدَيِ السَّاعة بالسَّيف، حتى يُعبَدَ اللهُ وحدَه لا شريك له، وجُعِلَ رِزْقي تحت ظلِّ رُمْحي، وجُعِلَ الذَّلُّ والصَّغار على مَنْ خالَف أمري، ومَنْ تَشَبَّهَ بقومٍ فهو منهم
“ ... যে যে জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে (আখেরাতে) সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” [মুসনাদে আহমদ : ৫১১৪, আবু দাউদ : ২/৫৫৯] কারো জন্মদিন পালনের কোন সূত্র/প্রমাণ ইসলামে নেই। রয়েছে খ্রিস্টান ও হিন্দুদের মধ্যে। হাদিস দ্বারা প্রমাণ হয়, জন্মদিন পালনকারী হাশরের ময়দানে খ্রিস্টান ও হিন্দুদের অন্তর্ভুক্ত হবে। মুসলমানদের মধ্যে গণ্য হবে না।
এক্ষণে এ রচনার মূল বক্তব্যে বলতে চাই, ১২ রবিউল আউয়াল রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিন পালন হিসেবে ‘ঈদে মিলাদুন নবী’ উদযাপন তথা এ সংশ্লিষ্ট যত কাজ করা হয় তার সবই বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুসরণ। ইসলামের নাম করে মুসলমানদের হিন্দু-খ্রিস্টান-বিধর্মীদের অনুসরণ করিয়ে হাশরের ময়দানে তাদের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে আল্লাহর দরবারে হাজির করার ঘৃণ্য চক্রান্ত বৈ হতে পারে না। এ ব্যাপারে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সতর্কবাণী হল :
عن أبي هريرة قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لا تجعلوا بيوتكم قبورا ولا تجعلوا قبري عيدا وصلوا علي فإن صلاتكم تبلغني حيث كنتم
“... তোমরা আমার কবরকে ঈদ উদযাপনের লক্ষ্যস্থল বানিও না। (আয়োজন-উৎসব ব্যতীত) আমার ওপর দরুদ পাঠ করতে থাক। তোমরা যেখানেই থাক তোমাদের দরুদ আমার নিকট পৌঁছে দেওয়া হয়।” মিলাদ বা জন্ম-অনুষ্ঠান শারীরিক সত্তার সাথে সম্পৃক্ত। এ জন্যই যে কোন শিশু থেকে নিয়ে বৃদ্ধ পর্যন্ত -সে যেই হোক- তার জন্ম-অনুষ্ঠান করা হয় বা করা যায়। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শরীর মোবারক কবরে বিদ্যমান। হাদিসে কবর দ্বারা রসুলের শারীরিক সত্তার সাথে সম্পৃক্ত যে কোন প্রকার আয়োজন-উৎসবকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিপরীতে দরুদ পাঠের তালিম দিয়ে আল্লাহ জাল্লা জালালুহু আমলের যে পদ্ধতি দান করেছেন সে পদ্ধতিতে ইবাদতের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে।
নিজেদের দীনদার হিসেবে দাবিকারী, বিদআত কুসংস্কার নির্মূলকারী একদল লোক আবার এ দিনে মিলাদুন নবী বাদ দিয়ে ‘সিরাতুন নবী’ নামকরণে নবী-জীবনে আলোচনার আয়োজন করে থাকেন। নবী-জীবনী প্রতিটি মুসলমানেরই প্রিয় বিষয়। আত্মার খোরাক। হৃদয়ের স্পন্দন। কিন্তু তাই বলে, তা করার জন্য ১২ রবিউল আউয়াল বা ১-২ দিন আগে-পরের তারিখটা ছাড়া বছরের বাকি ৩৫০ দিন কেন এ তালিকায় আসে না। মূলত এর মধ্য দিয়ে কি ইসলামে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত দিবস পালনকেই সমর্থন করা হয় না?
কবি তার কবিতায় বলেছেন, “রবিউল আউয়াল এলে তোমারই গান গাই/ রবিউল আউয়াল গেলে তোমায় ভুলে যাই/ তোমার নামে দরুদ পড়ি/ তোমার প্রেমে গড়াগড়ি/ মুখে বলি ভালোবাসি/ অন্তরেতে নাই/ রবিউল আউয়াল গেলে তোমায় ভুলে যাই/ তোমার সে-নাম ঘরে টানাই/ তোমার নামে ব্যানার বানাই/ মনের ভিতর তোমারই নাম/ করি না খোদাই.../ রবিউল আউয়াল গেলে তোমায় ভুলে যাই/ তোমার নামে জলসা-কিয়াম, সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম/ কিন্তু তোমার সমাজ গড়ার/ উদ্যোগী যে নাই/ রবিউল আউয়াল গেলে তোমায় ভুলে যাই/ রাসূল প্রেমে কান্নাকাটি/ নির্ভেজাল হোক, হোক না খাঁটি-/ তাঁর দেখানো রাস্তা ধরে মুক্তি খুঁজে পাই/” বার মাসে তের পূজার মতো দিবস সর্বস্ব ধর্ম হিন্দুসমাজের পাশাপাশি থাকতে থাকতে ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মুসলমান আমরা এমন এক রুচি ধারণ করেছি যে, উপর্যুক্ত কবিতাটিও রবিউল আউয়াল মাসে বিশেষ করে ১১ থেকে ১৫ তারিখের মধ্যে অধিক পরিমাণে আবৃত্তি বা গেয়ে থাকি। বাকি সারা বছর কাউকে গাইতে, আবৃত্তি করতে কখনো শোনা যায় না।
কেউ হয়ত যুক্তি দিবেন, বিদআতীদের মিলাদুন নবীর বিরুদ্ধে আমরা যদি সিরাতুন নবী উদযাপন না করি তবে জনসাধারণ বিদআতের পক্ষে চলে যাবে। কিন্তু আমি বিনয়ের সাথে জিজ্ঞাসা করতে চাই, হাদিসে কঠোর ভাষায় নিষিদ্ধ বিজাতীয়দের অনুসরণের মাধ্যমে মিলাদের বিদআতকে মোকাবেলা করার অথরিটি তারা কোথায় পেলেন? সিরাতুন নবীর মাধ্যমে মিলাদুন নবীর বিরোধিতা না হয় হল কিন্তু জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী পালনের রুসুম জিন্দা করার অধিকার তো ইসলাম কাউকে দেয়নি; কঠোরভাবে নিষেধ করে দিয়েছে।
সমাপ্তিতে বলতে চাই, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ পৃথিবীতে আগমন-প্রস্থান উভয়টিই হয়েছে। প্রতিটি মানুষেরই তা হয়ে থাকে। তিনি যে মিশন নিয়ে এসেছেন সে মিশন বাস্তবায়ন করাই আমাদের কর্তব্য। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিজ পিতা-মাতা, সন্তানসন্ততি তথা পৃথিবীর সব মানুষের চেয়ে অধিক ভালোবাসা, অধিক মুহাব্বত করা সে মিশনেরই একটি বৃহৎ অংশ। তবে সে ভালোবাসা যেন প্রতীকী ভালোবাসা না হয়ে বাস্তবিক ভালোবাসায় পরিণত হয়; সে জন্য আমাদের করণীয় হবে- কুরআন সুন্নাহর বিপরীত রবিউল আউয়াল মাসসংশ্লিষ্ট কোন কিছুতে অংশগ্রহণ না করে জীবনের প্রতিটি ক্ষণে প্রতিটি কাজে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রকৃত অনুসরণের চেষ্টা করা। সব সময়ই তাঁর ওপর অধিক পরিমাণে দরুদ পাঠ করতে থাকা। “বালাগাল উলা বি-কামালিহি/ কাশাফাদ-দুজা বি-জামালিহি/ হাসুনাত জামিউ খিসালিহি/ সল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি।”
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন