ভালো ও কল্যাণের/ যা তুমি জানো, যা জানো না/ যা তুমি ভাবো, যা ভাবো না/ সবই নিহিত দুরুদ ও সালামে
ভালো ও কল্যাণের
যা তুমি জানো, যা জানো না
যা তুমি ভাবো, যা ভাবো না
সবই নিহিত দুরুদ ও সালামে
اللهم صل على محمد عبدك ورسولك وصل على المؤمنين والمؤمنات والمسلمين
والمسلمات
আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ খাস রহমত দুরুদ ও সালাম পাঠকারীর ওপর মুষলধারে বর্ষিত হতে
থাকে। সাধারণ নিয়ম হলো পরস্পর
স্ববিরোধী দুটি বিষয় একই সময়ে
একই বস্তু বা বিষয়ে বিদ্যমান হয় না। যেমন জরিমানার মাধ্যমে উপহার প্রদানের সন্তুষ্টি অর্জন অসম্ভব। আবার কতক বিষয় এমন হয়, স্ববিরোধী না
হলেও পরস্পরে ধারাবাহিকতা আবশ্যক।
একত্রে হয় না। একটির পর অপরটি অর্জন সম্ভব। যেমন কারো সাথে কোন অন্যায়ের কারণে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেলে প্রথমে ক্ষমা প্রার্থনার
মাধ্যমে অপরাধ মার্জনা করাতে হয়। এই ক্ষমা প্রার্থনা
দ্বারা মার্জনা পেলেও এতেই পূর্বেকার সুসম্পর্ক ফিরে
আসে না; বরং ক্ষমা লাভের পর পুনরায় বিভিন্ন সদাচরণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সুসম্পর্কটা ফিরে আসে। কিন্তু দুরুদ ও সালাম এই ধরনের সীমাবদ্ধতার বহু ঊর্ধ্বের এক নেয়ামত। রসূলে
কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনই এক মহান সত্তা, তাঁর সাথে সম্পর্কিত
দুরুদ ও সালামে সাধারণ নিয়ম নয়; এক অতি নিয়ম কার্যকর। এখানে একই সময়ে বহু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যধারী,
স্ববিরোধী, ধারাবাহিকতা-আবশ্যক
এমন গুণ-বৈশিষ্ট্য-নেয়ামত
একত্রে লাভ হয়। নিচে এমন কিছু
নেয়ামতের আলোচনা করা হচ্ছে।
যেমন ইবাদত ও আনুগত্য। আমরা জানি এবং খুব
সহজে বুঝি, ইবাদতের মাধ্যমে আনুগত্য প্রকাশ করতে হয়। ইবাদত হচ্ছে শরীরের কোন প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে কৃত
কাজ। আনুগত্য হচ্ছে মনের একটি
বিশেষ অবস্থা বা হালাত। বাহ্যিক কাজের সাথে
সাথে যদি মনের অবস্থা সেরূপ না হয়- ইবাদত তো
বলা যাবে কিন্তু ঐ ইবাদতটা প্রকৃত ইবাদত নয়। এতো আনুগত্যহীন নিছক শারীরিক
কসরতমাত্র। অপরদিকে দুরুদ
শরীফ এমন এক মহান নেয়ামত, দুরুদ
শরীফ পাঠ করাটা শর্তহীনভাবে একই
সময়ে অবশ্যই ইবাদতও আবার আনুগত্যও।
যেমন দোয়া ও অফা। প্রার্থনা ও কৃতজ্ঞতা। প্রার্থনা হচ্ছে কারো নিকট কিছু চাওয়া। তার কাছ থেকে পেতে চাওয়া। কৃতজ্ঞতা হলো অতীতে পাওয়া দানকে বারবার স্মরণ করা, স্বীকৃতি দেওয়া। অথবা অতীত দানকে স্মরণ করে বর্তমানে তাকে কিছু দেওয়া। কিন্তু দুরুদ
শরীফ পাঠ করাটা অতীত-বর্তমানের সমষ্টি। চাওয়া-দেওয়ার সমষ্টি। একই সময়ে দোয়াও আবার অফাও। প্রার্থনাও আবার কৃতজ্ঞতাও।
যেমন জিকির ও ফিকির। সাধারণ নিয়ম হল চিৎকার-শ্লোগান-জোড়
আওয়াজে আবৃত্তির সময় অনুভূতি তেমন
নাড়া দেয় না। ফিলিংস বা ফিকির তৈরি হয় না। আবার যখন কোন প্রিয় বা শ্রদ্ধাভাজনকে নিয়ে কল্পনার আকাশে, অনুভবের জগতে হারিয়ে যায়। বিশেষ ফিকির বা ফিলিংস তৈরি হয়- সে সময়ের চাহিদা হয় নীরব নিস্তব্ধতা। অপরদিকে দুরুদ শরীফ এমন এক মহান নেয়ামত যে, পাঠ
করাটা একই সময়ে একত্রে জিকিরের মর্যাদা লাভ করে আবার ফিকিরও গণ্য হয়। [গভীর মনোযোগে ভক্তি ভালোবাসায় বিভোর হয়ে উচ্চৈঃ আওয়াজে দুরুদ শরীফ পাঠ করতে থাকলে একসময় ফিকিরটা নিজেই অনুভব
করবেন, ইন শা’ আল্লাহ। -অনুবাদক]
যেমন কুরব ও সোহবত। নৈকট্য ও সাহচর্য। আমাদের জ্ঞান বলে প্রথমে নিকটে যেতে হয়। নিকটে যেতে যেতে পূর্ণ নিকটবর্তী হয়ে গেলে তখন
সাহচর্য লাভ হয়। এটা তো বাহ্যিক নিয়ম। আবার অন্তরের দিক দিয়ে ভাবলে, প্রথমে দীর্ঘ সোহবত গ্রহণ করতে হয়। সান্নিধ্যে থাকতে হয়। থাকতে থাকতে একসময় মনের নৈকট্য অর্জন হয়। দুরুদ
শরীফ এমনই এক মহান নেয়ামত যে,
পাঠ করাটা একই সময়ে একত্রে এবং প্রথম থেকেই নৈকট্য ও সাহচর্য উভয়টা দান করে। কুরবও লাভ হয়, সোহবতও পাওয়া যায়।
যেমন কাফ্ফারা ও তরক্কি। ক্ষতিপূরণ ও উন্নতি। জরিমানা ও জমা। কেমন আশ্চর্য কথা! অতীতে যে ক্ষতি আমার দ্বারা হয়ে গেছে তার ক্ষতিপূরণ বা জরিমানা
আদায় করছি এটা তো অন্যের প্রাপ্য। আমার একাউন্টে এখান থেকে কিছু আবার জমা হবে কেন?
ক্ষতিপূরণ যখন শেষ হবে, জরিমানা যখন পূর্ণ আদায় হবে, এরপর যদি আমি আরো কিছু দেই সেটা না হয় আমার নিজ
হিসাবে জমা হওয়ার দাবি রাখে। অথচ দুরুদ শরীফ এমনই এক মহান নেয়ামত যে, পাঠ করার
মাধ্যমে একই সময়ে একত্রে অতীতের গুনাহের কাফফারাস্বরূপ গুনাহ মাফ হতে থাকে আবার পৃথক ইবাদত হিসেবে গণ্য
হয়ে এর সওয়াব আমলনামায় লিপিবদ্ধ হতে থাকে। এর মাধ্যমে আখেরাতের স্তরের উন্নতি, উচ্চ মর্যাদা
লাভ হতে থাকে।
যেমন ফালাহ ও পরওয়াজ। সফলতা ও উন্নতি। আমি আমার একাউন্টে জমা দিলাম এক লাখ টাকা। কিছুদিন পর ভিসা কার্ডের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকার কেনাকাটা করলাম। এরপর যদি ব্যালেন্স চেক করি এখন কত থাকবে? ৫০ হাজার অবশিষ্ট থাকবে, তাই না? দুনিয়ার সব কিছুতে এই একই হিসাব। যতটুকু সেবা আমি গ্রহণ করেছি পুঁজি থেকে ততটুকু কমে যাবে এটাই সিদ্ধ। দুরুদ শরীফ এমনই এক মহান নেয়ামত,
এর মাধ্যমে হাজার রকম সফলতা আসতে থাকবে কিন্তু এর বিনিময় হিসেবে মূল পুঁজি থেকে কিছুই কর্তন করা হবে না। কেমন যেন ৫০ হাজার টাকার কেনাকাটা করার পর ব্যালেন্স
চেক করে দেখি এখনো পূর্ণ এক লাখই জমা রয়েছে।
যেমন ইশক ও মাস্তি। প্রেম (ত্যাগ) ও আনন্দ (ভোগ)। প্রেমের ধর্ম হল বিসর্জন চাওয়া। প্রেম মানে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়া। মাশুকের
প্রতি প্রেম নিবেদন করতে করতে, প্রেমের নজরানা পেশ করতে করতে- প্রেমিক যখন নিঃস্ব ক্লান্ত আশাহত
ভগ্নহৃদয়; তারপর দীর্ঘ প্রতীক্ষার
অবসান ঘটিয়ে একদা হয়ত মাশুক প্রেমে সারা দেন। তখন গিয়ে স্বার্থক হয় বিসর্জন
আর বিলিয়ে দেওয়া। এরপর এই স্বার্থক প্রেমিক তার মাশুককে নিয়ে আনন্দ বিহ্বলতায় বিভোর হয়ে থাকে। উল্লাসে
মেতে ওঠে। এটাই জগতের নিয়ম। এ নিয়ম
রক্ষা করতে গিয়েই ইতিহাস সৃষ্টি করেছে “খুন
দেনেকা মজনু”। দুরুদ শরীফ এমন এক মহান নেয়ামত
যে, এখানে প্রথম দিন থেকেই ভোগের শান্তি আর ত্যাগের প্রশান্তি একত্রে পাওয়া যায়।
প্রেমও আনন্দও। ইশকও মাস্তিও।
যেমন উরূজ ও পরওয়াজ। উড্ডয়ন ও বিচরণ। উদাহরণস্বরূপ একটি পাখি বা উড়োজাহাজকে কল্পনা করি। গাছের ডালা আর রানওয়ে থেকে হঠাৎ করেই্ আকাশে বিচরণ শুরু করা সম্ভব নয়। একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত উড্ডয়নের পর শুরু হয় বিচরণ। দুরুদ
শরীফ এমনই এক মহান নেয়ামত যে, প্রথমবার পাঠ থেকেই
একদিকে রসুল কারীম সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মহব্বতের সুউচ্চ
আকাশের দিকে উড্ডয়ন যেমন শুরু হয়;
তেমনি প্রথমবার পাঠ থেকেই শুরু হয়ে যায় মহব্বতের অসীম আকাশে বিচরণ। একই সাথে
একত্রে উড্ডয়নও বিচরণও।
যেমন মাআফি ও তালাফি। ক্ষমা ও ক্ষতিপূরণ। কারো কোন পাওনা সময়
মতো না দিলে এতে তিনি যে রাগান্বিত হন, সে জন্য তার নিকট ক্ষমা চাইতে হয়। কিন্তু এই ক্ষমা চাওয়ার দ্বারাই যে পাওনা পরিশোধ
করা হয় নাই তা পরিশোধ হয়ে যায় না; বরং
পৃথকভাবে পরিশোধ করতে হয়। ঠিক তেমনি আল্লাহপাকের
হুকুম অমান্য করে আমরা যেমন আল্লাহকে রাগান্বিত করেছি আবার অবশ্য করণীয় আমল না করায়
আমলনামার খাতাতেও বকেয়া হয়ে গেছে। এজন্য
তাওবা ইস্তেগফারের মাধ্যমে
আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইতে হয়। আবার বিভিন্ন রকম
নফল আমলের মাধ্যমে বকেয়া পরিশোধের ন্যায় ক্ষতিপূরণও করতে হয়। দুরুদ
শরীফ এমনই এক মহান নেয়ামত যে,
এর মাধ্যমে ক্ষমা ও ক্ষতিপূরণ উভয়টা
একত্রে হতে থাকে।
যেমন হাদিয়া ও জখিরাহ। উপঢৌকন প্রদান ও নিজ ভাণ্ডার সমৃদ্ধকরণ। একটি জিনিস যদি আপনি কাউকে হাদিয়া বা উপহার হিসেবে
প্রদান করেন তাহলে তা তার মালিকানায় চলে যায়। এর ওপর হাদিয়াদাতার আর কোন অধিকার থাকে না। আবার যে জিনিস আমি নিজস্ব মালিকানায় জমা করে রাখতে
চাই তা কাউকে উপহার হিসেবে দিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। অথচ
দুরুদ শরীফ এমন এক মহান নেয়ামত
যে, প্রতিবার দুরুদ শরীফ পাঠ অর্থই হচ্ছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ নির্দেশিত হাদিয়া পেশ
করা। উপহার উপঢৌকন
প্রদান করা। আবার উপহার দেওয়া এই প্রতিটি দুরুদই দুরুদ পাঠকারীর আমলনামায় তার
নিজস্ব ভাণ্ডারে জমা হয়ে থাকবে। একেই বলে উপঢৌকন প্রদান ও নিজ ভান্ডার সমৃদ্ধকরণ। হাদিয়াও জখিরাহও।
বিগত দশটি প্যারায় বিপরীতমুখী বিশটি বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মে যা একত্রে হওয়ার নয়; অথচ দুরুদ
শরীফের মত এক মহান নেয়ামতের উসিলায়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মত
একমাত্র রহমাতুল্লিল আলামীনের সৌজন্যে বিপরীতমুখী বৈশিষ্ট্যগুলোর অনন্য সম্মেলন বিবৃত
হয়েছে। মুহতারাম লেখক বিশ নয় মোট বাইশটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। বিশটি তো যথাসাধ্য আমার এই দুর্বল কলমে অনুবাদ করলাম। বাকি থাকা দুইটি অনুবাদ বা আলোচনা না করে আশিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম পাঠকবৃন্দের অনুভবের জন্য রেখে দিলাম। সে দুটি হল রহমত ও বরকত।
এই প্রবন্ধের শেষে শ্রদ্ধেয় লেখক লিখেছেন, প্রিয় পাঠক! দুরুদ শরীফ সম্বন্ধে যা বললাম, এগুলো শুধু
কলমের জোরে লিখলাম বা চাপার জোরে
বললাম এমন কোন বিষয় নয়। যা বললাম এর সবই শতভাগ বাস্তব। অতিবাস্তব।
পরাবাস্তব। প্রতিটি দাবির পিছনে দলিলও রয়েছে। বাস্তব জীবনে পাওয়ার নজিরও রয়েছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন