আমি একাই জাহান্নামী

বনি ইসরাইল গোত্রে এক আবেদ ছিলেন। চারশত বছর যাবৎ ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল। একদিন মুনাজাতে বলছেন- আয় আল্লাহ! আপনি যদি পাহাড় সৃষ্টি না করতেন; আপনার বান্দাদের জন্য স্থলপথের ভ্রমণ সহজ হত। জমানার পয়গম্বরের নিকট ওহী অবতীর্ণ হল। নবী এসে আবেদকে বললেন : আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টিতে নাক গলানোর অধিকার তোমায় কে দিয়েছে? অনধিকার চর্চার ফলে আল্লাহ তা‘আলা নেককারদের তালিকা থেকে মুছে তোমার নাম বদকারদের তালিকায় লিখে দিয়েছেন। আবেদ খুশি হয়ে শুকরিয়ামূলক সেজদা আদায় করল। নবী জিজ্ঞাসা করলেন, আরে হতভাগা! এমন চরম দুর্ভাগ্যের খবরে শুকরিয়া-সেজদা আদায়ের অর্থ কী? ‘আমি দুর্ভাগ্যের ওপর শুকরিয়া করিনি; বরং আমার নাম যে আল্লাহ রব্বুল আলামিনের কোন একটা তালিকায় রয়েছে- সেজন্যই আমি শুকরিয়া আদায় করেছি।’
ওহে আল্লাহর নবী! আমার একটি আবদার। আল্লাহ রব্বুল আলামিনের দরবারে আমার এ দরখাস্ত পেশ করুন, যখন আমাকে জাহান্নামে ফেলবেন; যেন আমার শরীর এত বিরাটাকায় করে দেন যে, পুরো জাহান্নাম ভরাট হয়ে যায়- যেন আল্লাহর অন্য সব বান্দা জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতে যেতে পারে। ওহী আসল, আমার বান্দাকে বলে দাও- তাকে লাঞ্ছিত করার জন্য আমি এই পরীক্ষা নেই নাই। পরীক্ষা নিয়েছি যেন আল্লাহর বান্দাদের প্রতি তার ভালোবাসা প্রকাশ পায় এবং শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণের বিনিময় কিয়ামতে যার জন্য ইচ্ছা সুপারিশ করার সুযোগ তাকে দেওয়া হবে। যাদের জন্যে সুপারিশ করবে তারা বেহেশতে যাবে। 
শিক্ষা : উম্মতের দুনিয়াবী প্রয়োজন-সহজতার চিন্তায় কতটুকু মগ্ন হলে এমন ভাবনা আসে- উম্মতের প্রতি দরদের সাগরে নাওয়া ব্যতীত অনুভব করা সম্ভব নয়। ‘পাহাড় না বানানো’ এ অভিযোগ ছিল না; এ ছিল উম্মত-দরদ-সাগর আর মা‘রেফাতে এলাহীর সাগর, এই দুই সাগরের মোহনায় নববী ফিকরের বাতাস প্রবাহে সৃষ্টি ঝড়ে চমকানো বিজলীর গর্জনমাত্র। মারেফাত-সাগরে তুফান শুরু হলে, মুহাব্বতের দরিয়ায় ঢেউ উঠলে এমন হতেই পারে। তবে এটা শরিয়তে প্রশংসিত নয়। তাইতো যুগের শরিয়ত প্রবক্তা নবীর মাধ্যমে পাঠানো হল ধমক। 
স্রষ্টার ইবাদত যদি সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা জন্মাতে ব্যর্থ হয়; বুঝব- আমার ইবাদতে ত্রুটি রয়েছে। তাসাউফের মেহনতের উদ্দেশ্য সাধিত হচ্ছে না। তাসাউফ একটি মেহনত যা একই সাথে নিজের মধ্যে মন্দ-নিকৃষ্টতার অনুভূতি বৃদ্ধি ও আখলাক-চরিত্রের উন্নতি সাধন করে। নিকৃষ্টতার অনুভূতি ভিন্ন শুধু উন্নতি একটি চরম ধোঁকা। এ ধোঁকায় পতিত হয়ে গেলে ঐ সালেকের (মুরিদ) জন্য সঠিক পথ পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। নিকৃষ্টতার অনুভূতি বৃদ্ধির গতি-অনুযায়ী অন্য মুসলমান, ইনসান, সকল প্রাণী, কীট-পতঙ্গ, পোক-মাকড়কেও নিজের চেয়ে উত্তম মনে হবে। মনে প্রাণে বিশ্বাস ও সে অনুযায়ী জীবনের প্রতিটি কথা-কাজ প্রকাশ পেতে থাকবে- তাহলেই সার্থক হবে তাসাউফের মেহনত। আত্মশুদ্ধির চর্চা। এতেই লুকিয়ে আছে মুরিদ হওয়ার সার্থকতা।
পুনশ্চ : প্রথমে মুসলমান দ্বিতীয়তে ‘ইনসান’ বলে মুসলিম-অমুসলিম সকলকে বোঝানো হয়েছে। এতে সম্মানিত পাঠকের প্রশ্ন হতে পারে, অমুসলিম আবার মুসলিম থেকে উত্তম হয় কীভাবে? বাক্যের উদ্দেশ্য মূলত তা নয়। একজন সালেক যখন নিজের গোনাহের পাহাড় দেখতে পাবে, তখন আপনা থেকেই তার এ অনুভূতি জাগবে মৃত্যুকালে ঈমান নসিব হওয়ার উপযুক্ততা তো হারিয়ে ফেলেছি। এখন একমাত্র রহমানুর রহিম মাওলায়ে পাকের রহমত ব্যতীত ‘ঈমানী মউত’-এর কোন আশা বাকি নাই। আমলানুযায়ী যদি ফয়সালা হয় নিশ্চিত জাহান্নাম; বিপরীতে সারা দুনিয়ার অমুসলিম যে কাউকে আল্লাহ চাইলে মৃত্যুর পূর্বে যদি তাকে ঈমানের দৌলত দান করেন, তাহলে তো সে অবশ্যই আমার চেয়ে উত্তম। প্রকৃত সালেকের অন্তরে এ ভাবনাও সর্বক্ষণ জাগ্রত থাকা ও সে হিসেবে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে মোনাজাতের হালাতে থাকা উচিত।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

“সকাল বেলার ধনীরে তুই ফকির সন্ধ্যা বেলা”

দুরুদে সালাত শব্দ থাকা আবশ্যক সালামে থাকবে س ل م

দুটি রহস্যান্মোচন