আত্মিক উৎকর্ষসাধন ব্যতীত শান্তি অসম্ভব
আত্মা বা রূহ আর সর্বোন্নত কাঠামোসমৃদ্ধ শরীর এ দুয়ের সমন্বিত শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ। সর্বোন্নত কাঠামোসমৃদ্ধ এ শরীরটার সৃষ্টি অবলম্বনময় এ জগতে। পিতার পৃষ্ঠদেশ থেকে শুরু, মাতৃগর্ভে পূর্ণাঙ্গ রূপদান অতঃপর পৃথিবীনামক পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রবেশ ও ধারাবাহিক বৃদ্ধি-ক্ষয়। নির্ধারিত সময়ের পর প্রস্থান এবং কবরজগতে নিঃশেষিত হয়ে পুনরায় পৃথিবীর গর্ভে বিলিন হয়ে যাওয়া। এ জগতে সৃষ্টি হেতু এর প্রয়োজন পূরণের হাজারো উপকরণ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এ জগতেই। জগতময় বিক্ষিপ্ত এই উপাদানসমষ্টি থেকে আমরা খুঁজে নেই শারীরিক সচলতা ও সুস্থতার প্রয়োজনীয় সামগ্রী। বরং সচলতা-সুস্থতার প্রয়োজন পূরণের পর বিলাসিতার সামগ্রী তালাশের জোয়ারেও ভাটার টান লাগতে দেই না। শরীরের ন্যায় আত্মার সুস্থতা-সচলতার জন্যও অবশ্যই প্রয়োজন নির্দিষ্ট প্রকার সামগ্রীর।
আত্মা বা রূহ ইহজাগতিক কোন পদার্থ-অতিপদার্থ জাতীয় কিছু নয়। রূহ হচ্ছে মহান রব্বুল আলামিনের একটি হুকুম। যার প্রকৃতি-বাস্তবতার উপলব্ধি বা জ্ঞান মানব মস্তিষ্ক-সাধ্যের অতীত; এটি ঊর্ধ্বজাগতিক একটি স্থায়ী সৃষ্টি। এ সৃষ্টিটির সুস্থতা-সচলতার কোন আয়োজন ইহজগতে নেই। ইহজাগতিক সৃষ্টি শরীরের সব প্রয়োজন যেমন ইহজগতেই পূর্ণ হয়; তেমনি ঊর্ধ্বজাগতিক রূহের সকল প্রয়োজন ঊর্ধ্বজাগতিক সামগ্রী দ্বারাই পূর্ণ করতে হয়। ইহজগতে রূহের প্রয়োজনীয় সামগ্রী নেই শুধু এতটুকুই নয়; বরং ইহজগতের প্রতিটি বস্তু রূহের জন্য ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াসদৃশ : প্রতিনিয়ত আঘাত করে করে দুর্বল ও অসুস্থ করে তোলে রূহকে। তাই ইহজাগতিক সামগ্রীর ব্যবহারে হতে হয় অতি সাবধান-সংযমী। সর্বক্ষণ লাগিয়ে রাখতে হয়- মাস্ক, গ্লাফস, এপ্রোন এবং ব্যবহার করতে হয় হেক্সিসল-ডেটলসহ অন্যান্য প্রটেকটর।
ঊর্ধ্বজাগতিক রূহের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যবহার ও ইহজাগতিক ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াসমূহের আঘাত থেকে রক্ষা পাওয়ার পদ্ধতি শিক্ষাদানের জন্যই আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদের প্রতি তাঁর অপার অনুগ্রহ হিসেবে আম্বিয়া আলাইহিমুস্ সালামকে প্রেরণ করেছেন। আম্বিয়া আলাইহিমুস্ সালাম ঊর্ধ্বজাগতিক রূহের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর সঠিক-সুনিপুণ ব্যবহার ও ইহজাগতিক ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াসমূহের আঘাত থেকে রক্ষা পাওয়ার শক্তিশালী ও সর্বাধিক ফলদায়ক পদ্ধতি তথা বাস্তবচর্চাকরণের মাধ্যমে উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় সরদারে দো-আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমন ঘটে এবং কুরআনে হাকিমের আকারে বিশ্বমানবতাকে অতীব সংঘবদ্ধ সুনিপুণ বিধান দান করা হয়। যাতে আত্মিক ও দৈহিক চাহিদাসমূহের অভ্যন্তরে লুকায়িত উপকার ও ক্ষতির চূড়ান্ত বর্ণনা, উপকার অর্জন, ক্ষতি বর্জনের পন্থা ও পন্থা অবলম্বনে জিন শয়তান-মানুষ শয়তান-নফসের তৈরি বাধার প্রাচীর ডিঙ্গানোর মনোবল যোগানো হয়েছে সবিস্তার। মানুষকে জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেচনা-চিন্তা-পরিকল্পনার মহান নেয়ামত দান করে আত্মিক ও দৈহিক চাহিদাসমূহের কোনটিকে কোন স্তরে রাখবে? কোনটিকে কতটুকু প্রাধান্য দিবে- এ ব্যাপারে পূর্ণ ইচ্ছা-স্বাধীনতা দান করেছেন মহান রব্বুল আলামিন।
যুক্তির চাহিদানুযায়ী মানুষ তার সুবুদ্ধি কাজে লাগিয়ে আত্মা ও দেহের প্রয়োজনাদির মধ্যকার ভারসাম্য বজায় রাখার কথা। কিন্তু রিপুর তাড়না ও শয়তানী প্রবঞ্চনায় আকর্ষণীয়, আনন্দদায়ক ও সত্যবিস্মৃত প্রশান্তির হওয়ায়- অস্তিত্বের প্রধান অনুষঙ্গ স্থায়ী সৃষ্টি রূহভোলা মানুষ ইহজাগতিক শারীরিক প্রয়োজনাবলি তথা বস্তুজগতের প্রতি অতি মাত্রায় ধাবমান। মানব-নফস পরিচালনার শক্তিতে পূর্ণ শক্তিমান, দেহাভ্যন্তরের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় প্রবাহের ক্ষমতা সংরক্ষণকারী দুশমন শয়তানের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা মানুষের বস্তুপূজার অন্যতম কারণ। বিপরীতে রূহ বা আত্মা সর্বান্তকরণে একটি খোদায়ী শক্তি- যা সর্বদাই সত্যের দিকে আহ্বানকারী একটি আলোকিত স্পন্দন। নফসের গোলামী ও বস্তুপূজায় কৃত প্রচণ্ড আঁধার এই আলোকরশ্মির আলোকছটা থেকে বঞ্চনা তৈরি করে।
দীনী শিক্ষা যদি সমাজ পরিচালনার মূল চালিকা শক্তি হয়- পরিবেশ থেকেই ইনসান আত্মিক চাহিদার যোগান পেতে থাকে। দীনী চর্চা আপন গতি হারালে, ধর্মীয় অনুশাসন দুর্বল হয়ে পড়লে, পুরো সমাজের ওপর বস্তুজড় বইতে থাকলে- আত্মা শক্তি হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। পরিণামে মানুষ নেকি-বদি, ভালো-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণের পার্থক্য ভুলে যায়। আজ সমগ্র মানবতা মূলত এ পরিস্থিতির শিকার। ব্যক্তি, জাতি ও আন্তর্জাতিক সকল পর্যায়ে বস্তুচর্চা-বস্তুপূজা মানবিক মূল্যবোধ থেকে কল্যাণ-অকল্যাণের পার্থক্য শক্তি পূর্ণমাত্রায় খর্ব করে দিয়েছে। অত্যাধুনিক উন্নতি-আগ্রগতি চর্চিত পশ্চিমাবিশ্ব বিজ্ঞানের চরম উন্নতি সাধনের সাথে পাল্লা দিয়ে পথভ্রষ্টতা তথা পশুসুলভ জীবনে অভ্যস্ত হয়ে মনুষ্যত্ব-নৈতিকতার সর্বশেষ অবলম্বনটুকুও নির্বাসিত করেছে। বাস্তবতা হল, আজকের সমাজে পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত ভদ্র লোকটি চরিত্রের প্রকৃত মানদণ্ড প্রাণীর চেয়ে নিম্নস্তরে পৌঁছে গেছে। জীবনোপকরণের আধিক্য ও ভোগ-বিলাসের সর্বোন্নত সর্বাধুনিক বস্তুনিচয়ের সমাহার সত্ত্বেও মানসিক শান্তির নাগাল যেন সুদূর অজানায় উড়ে যাওয়া পায়রা।
পূর্ব প্যারায় বর্ণিত কারণ ও দশা তো ছিল ইউরোপিয়ান-পশ্চিমা বিশ্বের লোকেদের। পরিস্থিতির নাজুকতা ধ্বংসের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছার পর তারা নতুন করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে এবং অনেকেই “আত্মিক উৎকর্ষসাধন ব্যতীত শান্তি অসম্ভব” ইসলামের এই মূলনীতি স্বীকার করে নিয়েছে। কতক তো আত্মিক চিকিৎসক বুজুর্গানে দীনের কিতাবাদি অধ্যয়নও শুরু করেছে এবং চিরশান্তির একমাত্র দীন ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য! অপরদিকে খোদ মুসলমান ইউরোপের অন্ধ অনুকরণে এমনভাবে মত্ত হয়েছে, ফিরে আসবে/ ফিরিয়ে আনা যাবে এমন আশাও দুরাশায় পরিণত হয়েছে ও পর্যবসিত হচ্ছে। আফসোস! যে জীবনাচার ইউরোপিয়ানদের বিকারগ্রস্ত করে বেঁচে থাকার সামান্য অবলম্বন থেকেও বঞ্চিত করে দিয়েছে, সে জীবনাচার আঁকড়ে ধরার জন্য মুসলমান পরস্পরে উন্মত্ত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। দীনহীনতা, দীনবিরোধিতা, ধোঁকা, হঠকারিতা, অবৈধ অর্থ লিপ্সা এমন কি চারিত্রিক স্খলনের মতো জঘন্য বিষয়াবলি আজ ইসলামী সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিকড় গেঁড়ে বসেছে। ফলশ্রুতিতে ব্যক্তি থেকে আন্তর্জাতিক জীবনের সব পর্যায়ে পরস্পর শত্রুতা, নিরাপত্তাহীনতা, ধেয়ে আসা বিপর্যয় মুসলমানদের চারিদিক থেকে গ্রাস করে নিয়েছে। হায়! পৃথিবীর নেতৃত্বের জন্য প্রেরিত জাতি আজ লক্ষ্যহীন জীবন নিঃশেষে বাধ্য-অসহায়।
একদিকে পশ্চিমা জাতিসমূহের আভ্যন্তরীণ ধ্বংস, জীবনাচারের ওপর লজ্জার অনুভূতি ও পরিশেষে ইসলামের “আত্মিক উৎকর্ষসাধন ব্যতীত শান্তি অসম্ভব” নীতির প্রতি পরম আকর্ষণ; অপরদিকে এই আত্মিক শক্তির ধারক জাতির দীনবিমুখতা, দীন থেকে পলায়ন-আমল বর্জন এমন বিচিত্র এক চরম বাস্তবতা- যা নিয়ে গভীর চিন্তা-ফিকির করা দীনদরদী প্রতিটি মুসলমানের প্রধান কর্তব্য।
পরিস্থিতির আলোকে বিশ্ব মুসলিমের দুর্দশার কারণে দীনের সাথে জড়িত সকলকে, বিশেষ করে দীন প্রচারের সাথে সংশ্লিষ্ট সম্মানিত ওলামায়ে কেরাম, ইসলামী চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গকে নিজেদের দায়িত্ব আদায়ের ব্যাপারে পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি সজাগ-সচেতন হতে হবে। নিজেদের চেষ্টা-মেহনত পূর্বের যে কোন সময়ের চেয়ে অধিক পরিমাণে করতে হবে। মনে রাখবেন, “আত্মিক উৎকর্ষসাধন ব্যতীত শান্তি অসম্ভব” ইসলামের এই মূলনীতিকে পাশ কাটিয়ে যতই মেহনত-মোজাহাদা করা হোক তাতে হয়ত বাহ্যিক দীন আসতে পারে; কিন্তু প্রকৃত দীনদারির জন্য আত্মিক উৎকর্ষ তথা তাসাউফের মেহনতের কোন বিকল্প নেই। কোন কালে ছিল না। আগামীতে হবেও না।সকলের প্রতি তাই উদাত্ত আহ্বান থাকবে, আসুন নিজের আত্মশুদ্ধির ব্যাপারে সর্বাধিক মনোযোগী হই। নিজের ব্যাপারে নিজে মনোযোগী না হয়ে শুধু বাহ্যিক আমল আর ইসলামী অনুষ্ঠান মনে করে কিছু কাজ করলেই কাক্সিক্ষত উন্নতি সাধিত হবে না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন