চমৎকার তাফসির : কুরতুবী
চমৎকার তাফসির : কুরতুবী
ان الله و ملائكته يصلون على النبي
يا ايها الذين امنوا صلوا عليه و سلموا تسليما
অর্থ : নিশ্চয়
আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর ওপর সালাত পাঠায়। হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তাঁর ওপর দুরুদ ও সালাম পাঠাও। [সুরা আহযাব : ৫৬]
১. আল্লাহ
তায়ালা এই আয়াতে মোবারকাতে আপন রসুল হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লামকে অনেক সম্মান দান করেছেন এবং তাঁর মহান মর্যাদার আলোচনা করেছেন। যারা রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম বা তাঁর পূতপবিত্র সম্মানিতা স্ত্রীগণের ব্যাপারে ভুল চিন্তা লালন করে তাদের এই অপকর্ম-অপচিন্তার মন্দপ্রভাব থেকে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লামকে নিরাপদ করে দিয়েছেন। ঘোষণা করেছেন তাঁর গুণকীর্তন আর প্রশংসা সর্বদা শুধু বৃদ্ধিই পেতে থাকবে।
২. আল্লাহ
তায়ালা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লামের ওপর ‘সালাত’ পাঠানোর অর্থ হলো, আল্লাহ তায়ালা নিজ রহমত ও সন্তুষ্টি নাজিল করা। ফেরেশতাগণের সালাত দ্বারা উদ্দেশ্য হয়, দোয়া ও ইস্তেগফার। উম্মতের সালাতের অর্থ হচ্ছে, দোয়া ও সম্মান প্রদর্শন-শ্রদ্ধা প্রকাশ। অর্থাৎ উম্মত সালাত পাঠানোর মতলব হবে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লামের জন্য দোয়া করবে اللهم صل على محمد এবং তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর বিধানাবলীর প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান প্রদর্শন করবে।
৩.
আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীগণের আ. মধ্যে শুধু হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লামের ওপর সালাত পাঠের হুকুম দিয়েছেন; যা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লামের প্রতি বিশেষ ‘সম্মাননা’। জীবনে অন্তত একবার দুরুদ ও সালাম পাঠ করা ফরজ- এ বিষয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। তাছাড়া সবসময়ের হুকুম হলো, এটা এমন সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ যা পরিহারের কোনো সুযোগ নেই। দুরুদ শরীফ-এর ব্যাপারে গাফেল তো শুধু ঐ ব্যক্তি হতে পারে যার মধ্যে কোন প্রকার কল্যাণের ছিটেফোঁটাও নেই।
প্রশ্ন হল, হুজুর আকদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লামের ওপর দুরুদ শরীফ পাঠ করা কি ওয়াজিব না নফল?
উত্তর, ওয়াজিব। তবে কখন ওয়াজিব হয় সে ব্যাপারে একাধিক মত রয়েছে। একটি মত এও রয়েছে যে, যখনই তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লামের আলোচনা হয় তখনই ওয়াজিব। কেননা হাদীস শরীফে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যার সামনে আমার আলোচনা হয় অথচ সে দুরুদ পড়ে না; সে জাহান্নামে যাবে এবং আল্লাহ তায়ালা তাকে নিজ রহমত থেকে বঞ্চিত করে দিবেন।
দ্বিতীয় মত, একটি বৈঠকে যতবারই হুজুরে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লামের নাম আলোচিত হোক একবার দুরুদ শরীফ পাঠ করা ওয়াজিব। আবার কতক ওলামায়ে কেরামের মতে জীবনে একবার ওয়াজিব। সতর্কতাস্বরূপ প্রতিবার নামোল্লেখের সাথে দুরুদ শরীফ পড়াই সমীচীন। এতে মুহাব্বতেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। সাওয়াব ও অন্যান্য পাওনা তো মিলবেই।
৫. দুরুদ
শরীফের ফজিলত নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:- “যে আমার ওপর একবার দুরুদ পাঠাবে আল্লাহ তায়ালা তার ওপর দশবার “খাস রহমত” নাজিল করবেন।”
হজরত সাহল বিন আব্দুল্লাহ রহ. ইরশাদ করেন, “হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লামের ওপর দুরুদ শরীফ পাঠ করা ইবাদতসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম। কেননা আল্লাহ তায়ালা প্রথমে নিজের ও ফেরেশতাগণের আমল বর্ণনা করেছেন: “আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লামের ওপর সালাত প্রেরণ করেন।” এরপর ঈমানদারদেরকে সালাতের হুকুম করেছেন। এছাড়া অন্য কোন ইবাদতের হুকুমের ক্ষেত্রে এরূপ করেননি।
হজরত আবু সোলাইমান দারানী রহ. বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার নিকট কোন প্রয়োজন পেশ করার ইচ্ছা করে সে যেন তার দোয়া দুরুদ শরীফ দ্বারা শুরু করে। এরপর নিজের প্রয়োজনের জন্য প্রার্থনা শেষ করে যেন পরিশেষে আবার দুরুদ শরীফ পাঠ করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা এই উভয় দুরুদ (দোয়ার শুরুতে ও শেষে পঠিত) অবশ্যই কবুল করবেন। অতএব, এটা আল্লাহ তায়ালার অপার করুণার সাথে সামঞ্জস্যশীল নয় যে, তিনি উভয় দুরুদকে তো কবুল করবেন আর মধ্যবর্তী দোয়াকে ফিরিয়ে দিবেন।”
হজরত সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব রহ. হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদি.-এর সূত্রে বর্ণনা করেন, “যখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লামের ওপর দুরুদ পাঠ করা হয় তখন দোয়া উপরে
উঠে অর্থাৎ কবুল হয়।”
৬. নামাজে দুরুদ শরীফ পাঠ করা নামাজের
সুন্নত-মুস্তাহাবের অন্তর্ভুক্ত। দুরুদ শরীফ ছুটে গেলেও নামাজ হয়ে যাবে- এটাই
অধিকাংশ আলেমের মত। ইমাম মালেক রহ. ও হজরত সুফিয়ান রহ. বলেন, শেষ বৈঠকে তাশাহুদের
পর দুরুদ শরীফ পাঠ করা মুস্তাহাব। বাদ দেওয়া অনুচিত-মন্দ কাজ। হারমালাহ ইবনে
ইয়াহইয়া ইমাম শাফেয়ী রহ. থেকে বর্ণনা করেন, শেষ বৈঠকে সালাম ফিরানোর পূর্বে দুরুদ
শরীফ পাঠ করা ওয়াজিব। যদি দুরুদ শরীফ না পড়ে তাহলে নামাজ পুনরায় পড়া ওয়াজিব।
৭. “
وسلموا تسليماওয়া-সাল্লিমু তাসলিমা” কাজী আবু বকর বিন বুকাইর রহ. বলেন, এই
আয়াত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লামের ওপর অবতীর্ণ হয়েছে। তিনি
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবাগণকে হুকুম করেছেন- তারা যেন
তাঁর প্রতি সালাম পাঠায়। সাহাবাগণকে হুকুম করার মাধ্যমে কেয়ামত অবধি সকল উম্মতকেই সালাম
পাঠানোর হুকুম হয়ে গিয়েছে। এই হুকুমের কারণে রওজা শরীফে হাজিরির সময় এবং যখন তিনি সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লামের আলোচনা হয় এই দুই সময় দুরুদ শরীফ পাঠ করা ওয়াজিব।
নাসাঈ শরীফের বর্ণনা, “একবার হুজুর
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাশরিফ আনলেন- তাঁর চেহারা মোবারকে আনন্দের ছাপ
স্পষ্ট ছিল। সাহাবী বলেন, আমি আরজ করলাম, আমরা আপনার চেহারায় আনন্দের ছাপ দেখতে
পাচ্ছি। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, আমার নিকট
ফেরেশেতা এসে বলল, আপনি কি এতে আনন্দিত ও সন্তুষ্ট নন যে- যে কেউ আপনার ওপর দুরুদ
পাঠ করবে আমি তার ওপর দশটি রহমত নাজিল করব এবং যে আপনার প্রতি সালাম প্রেরণ করবে
আমি তার ওপর দশটি সালাম (শান্তি-নিরাপত্তা) নাজিল করব।”
অন্য বর্ণনায় রয়েছে, হুজুর আকদাস
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি আমার ওফাতের পর আমার প্রতি
সালাম পাঠাবে তার সালাম হজরত জীবরীল আমার নিকট পৌঁছিয়ে দিবেন এবং বলবেন, অমুকের
পুত্র অমুক আপনার প্রতি সালাম পাঠিয়েছে। তখন আমি বলব, عليه السلام ورحمة الله و بركاته তার ওপর শান্তি
বর্ষিত হোক। আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত হোক এবং তার বরকত হোক।”
হুজুর আকদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লামের ইরশাদ:- আল্লাহ পাকের কিছু ফেরেশতা পৃথিবীতে বিচরণ করতে থাকে
এবং তারা আমার উম্মতের সালাম আমার নিকট পৌঁছিয়ে দেয়। আল্লামা কুশাইরী রহ. বলেন,
সালাম দ্বারা উদ্দেশ্য হল سلام
عليك বলা।
[তাফসীরে কুরতুবীর সারসংক্ষেপ, কৃত : ইমাম কুরতুবী রহ.]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন