যৌক্তিক কারণে অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত
“তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করিয়াছেন এবং উহার মনযিল নির্দিষ্ট করিয়াছেন যাহাতে তোমরা বৎসর গণনা ও সময়ের হিসাব জানিতে পার।” {সুরা ইউনুস : আয়াত ০৫}
নিজেদের কার্যসূচি তৈরি ও সময়ের হিসাব রাখার স্বার্থে আদিকাল থেকেই বিশেষ কোন ঘটনা ইত্যাদিকে একক ধরে সময় গণনা করা হত। প্রাপ্ত ইতিহাস মতে, প্রথমে চাঁদের হিসাবে বর্ষ গণনা-পঞ্জিকা-ক্যালেন্ডারের আবিষ্কার হয়। চন্দ্রবর্ষে ঋতু-নির্ধারণ-সমস্যা হেতু কালক্রমে আবিষ্কার হয় সৌরবর্ষ। ইতিহাসের একাধিক সূত্র মিলালে সিদ্ধান্ত নিতে হয়- সৌরবর্ষ আবিষ্কারের মূল গৌরব সুমেরীয় সভ্যতার হলেও; জ্যোতির্বিজ্ঞান, হিসাবনিকাশে এগিয়ে ছিল মিশর। মিশরীয় সভ্যতাই ৪২৩৬ অব্দ তথা ৬২৫৩ বৎসর পূর্বে পূর্ণাঙ্গ সৌর ক্যালেন্ডারের ব্যবহার শুরু করে। বিভিন্ন সময়ে সমকালীন সম্রাটদের অবদানে আজকের আধুনিক সৌর ক্যালেন্ডার আমাদের জীবনের গতির সাথে মিশে রয়েছে। তাদের মধ্যে সম্রাট রমুলাস (৭৩৮অব্দ), সম্রাট নুমা (৪৩২অব্দ), সম্রাট জুলিয়াস সিজার (৪৬অব্দ), সম্রাট অগাস্টাস -এদের দু’জনের নামেই যথাক্রমে কুইন্টিলিস মাস জুলাইয়ে আর সেক্সটিনিস মাস আগস্ট বা অগাস্ট-এ রূপান্তরিত হয়- সবিশেষ উল্লেখ্য।
২৫৫০ বৎসর পূর্বে আধুনিক ঈসায়ী ক্যালেন্ডার বা খ্রিস্টাব্দের গণনা শুরু হয় ডাইওনিসিয়াম এক্সিগুয়াস নামক পাদরীর হাত ধরে। ৫৩২ অব্দে চালু হওয়া ঐ ক্যালেন্ডারটিই সাইয়্যিদুনা হজরত ঈসা আ.-এর জন্মের মু‘জেজাপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে তাঁর জন্মের বছরকে প্রথম সাল বিবেচনা করে নতুন গণনা শুরু হয়।
কৃষি প্রধান এই দেশের আবওহাওয়ার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বঙ্গাব্দ-প্রবক্তা খুঁজলে সবচেয়ে আলো ঝলমল যে নামটি পাওয়া যায়- মহামতি আকবর। বিতর্কও কম নয়। স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ, গৌড়ের সম্রাট শশাঙ্ক, নবাব মুর্শিদকুলি খান ও তিব্বতি রাজা স্রং-সন বঙ্গাব্দের প্রবক্তা হিসেবে এ চারটি নামের পক্ষেও যুক্তি কম নয়। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানের বক্তব্য, “হাজার বছরের মধ্যে এমন কোনো নথিবদ্ধ তারিখ [ইতিহাস] আমাদের জানা নেই যেটাকে নিশ্চিতভাবে বঙ্গাব্দের সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে।” স্যারের বক্তব্যের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা ও সমর্থন জানিয়ে বলব- আমার মতে, বাংলা সনের মূল প্রবর্তক তিব্বতি রাজা স্রং-সন। স্রং-সন মূল প্রবর্তক হলেও এটা তার নিজস্ব গবেষণা বা চিন্তার ফসল নয়; বরং চন্দ্র বংশীয় রাজা বিক্রমাদিত্য প্রবর্তিত চন্দ্রবর্ষ ‘বিক্রম সংবৎ’ (বিক্রমী সাল) যার অভিষেক ঈসায়ী ক্যালেন্ডারেরও ৫৬ বছর পূর্বে, এই বিক্রম সংবৎ থেকে ধার করে বঙ্গাব্দের সূচনা করেন রাজা স্রং-সন। বাদশাহ আকবর তার শাসনামলে কৃষকদের থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে এবং হিজরি সনের বিকল্প অবদান জাহিরের নিমিত্তে স্রং-সনের চন্দ্রবর্ষকে সৌরবর্ষে রূপান্তর করেন।
আরবে চাঁদের হিসাবে দিন ও মাস গণনা বহুকাল থেকেই চালু ছিল। কিন্তু কোন বর্ষপঞ্জিকা ছিল না। কোন বড় ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্যালেন্ডার চালু হত। নতুন ঘটনায় সূচনা হত নতুন ক্যালেন্ডারের। যেমন ‘আমুল ফিল’ বা হস্তিবাহিনী আক্রমণের বছরও জন্ম দিয়েছিল একটি বর্ষপঞ্জির। হজরত ওমর ফারুক রাদি. নিজ শাসনামলে নথিপত্রে তারিখ ও মাস থাকলেও সন লিখিত না থাকায় তৈরি অযাচিত সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে হজরত উসমান, হজরত আলীসহ বিশিষ্ট সাহাবায়ে কেরাম রাদি.-এর সাথে পরামর্শক্রমে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের ঘটনাকে চির স্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে ঘটনার ১৭ বছর পর হিজরি ক্যালেন্ডার চালু করেন। দীর্ঘ ভুমিকা সঙ্গত নয়- জেনেও দীর্ঘ করে ফেললাম।
বাদশাহ আওরঙ্গজেবের শাসনামলে মোল্লা নেজামুদ্দীন বিন কুতবুদ্দীন আস-সেহালী রহ. (১৬৭৭-১৭৪৮) প্রণীত দরসে নেজামীর একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দ ও দেওবন্দের অনুসারী মাদরাসাসমূহ। প্রশ্ন হল, দেওবন্দ ইসলামী শ্ক্ষিার কেন্দ্র হেতু শিক্ষাবর্ষ হওয়া উচিত ছিল হিজরিবর্ষ অনুযায়ী মহররম থেকে জিলহজ। অথবা বাদশাহ আকবরের মাধ্যমে প্রসারিত বঙ্গাব্দ মতে বৈশাখ থেকে চৈত্র হলেও দোষ কী ছিল? অন্যথায় ইংরেজ বেনিয়া কবলিতকালে এ অঞ্চলে প্রসারিত ও দুর্ভাগ্যক্রমে অধিক প্রচলিত ঈসাব্দ হওয়াও যৌক্তিক ছিল; কেননা সে কালেই (১৮৬৬) দেওবন্দের গোড়াপত্তন। ৬০০০ বছর পূর্বের পৃথিবীতেও চালু ছিল ক্যালেন্ডার। মানুষ তাদের কার্যসূচি তৈরি করত বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস-শেষ মাস হিসাবে। তাহলে কেন কওমী মাদরাসার শিক্ষাবর্ষ শাওয়াল-শা‘বান/দশম-অষ্টম মাস? এ অঞ্চলে প্রচলিত তিনটি বর্ষপঞ্জির কোনটাকেই কেন গ্রহণ করলেন না দরসে নেজামীর পুনরুজ্জীবন দানকারী দেওবন্দের বাণীগণ? পূর্বাপর মিলিয়ে দেড় মাসের অধিক সময়কে শিক্ষাবর্ষের বাইরে রাখার যৌক্তিকতাই বা কী? অযৌক্তিক সিদ্ধান্তটির যুক্তি খোঁজাই প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য।
দেওবন্দ-দরসে নেজামী প্রধানত শিক্ষানির্ভর নয়; বরং মৌলিকভাবে দীক্ষানির্ভর প্রতিষ্ঠান (দিন দিন আমরা এই মৌলিকত্বকে ভুলে যাচ্ছি এবং একটু গভীর চিন্তা করলেই এর সমূহ ক্ষতি চক্ষুষ্মানদের চোখে ধরা পড়বে)। দীক্ষার মূল সূত্র আমলী মশক- অধিক আমলে অভ্যস্ত করা-হওয়া। রমজান আল্লাহর পক্ষ থেকে আমলের জন্য বিশেষ দান। অতএব লেখাপড়ার মূল উদ্দেশ্য অর্জনের নিমিত্তেই রমজানকে শিক্ষাবর্ষের বাইরে রাখা ছিল অপরিহার্য দাবি। এ মহান দাবিটাই পূরণ করেছেন দেওবন্দের মহান বাণীগণ। প্রশ্ন হতে পারে, এ মাসটা ছুটি রাখলেই হত। রমজানের প্রস্তুতি ও ঈদ পরবর্তী ছুটি মিলিয়ে লাগাতার দেড় মাস ছুটির বিকল্প ছিল না- সহজেই অনুমেয়। একটি শিক্ষাবর্ষের শেষ দিকে দেড় মাসের পাঠবিরতি শিক্ষার্থীদের জন্য কতটুকু ক্ষতিকর; তা ব্যাখ্যা করা- অন্তত এমন একটি রসহীন লেখা এ পর্যন্ত পাঠের ধৈর্য যাদের আছে, তাদের নিকট করা ঠিক হবে না।
আফসোস! দীক্ষা বিসর্জন দিয়ে শিক্ষানির্ভর হয়েছি, সে তো অনেক দিনের কথা। এখন হতে চলেছি পরীক্ষানির্ভর। প্রবাদ আছে- ‘উপরের দিকে থুথু ছিটালে নিজের মুখেই পড়ে’। অবাধ্য কলমটিকে সংবরণ করছি। আমাদের কর্ণধার মুহতারাম আসাতিজায়ে কেরামের নিকট আবেদন! দ্রুত লাগাম টেনে ধরুন। অন্যথায় ...
চিন্তার খোরাক আছে।
উত্তরমুছুন