প্রেমের মরা জলে ডুবে না
শিরোনামটি কৈশরে শোনা একটি বাক্য। একটি চলচ্চিত্রের নাম। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের সন্তান হওয়ায় টিভি-সিনেমার সাথে সম্পর্ক ছিল না। বাক্যটি প্রাইমারী বন্ধুদের মুখে শুনে শুনে স্মৃতিপটে আটকে যাওয়া। তখনকার বয়সে ‘প্রেম’ শব্দটা নিজের মতো করে বুঝলেও; -মনে পড়লে এখন হাসি পায়- প্রকৃত অর্থে বুঝতাম না কিছুই। চলচ্চিত্রের কাহিনি কী ছিল, কেন এ নামকরণ আমার জানা ছিল না, আজও জানা নেই। অন্য দশটা কিশোরের মতো ‘প্রেম’ শব্দটা নিয়ে একটা অজানা আগ্রহ নিজে নিজে একটা কাহিনি আবিষ্কার করেছিল। সংক্ষেপে, এক প্রেমিক, এক প্রেমিকা। দীর্ঘ দিন প্রেমের পর নায়কের শত্রু পক্ষ প্রেমিকাকে পানিতে ডুবিয়ে মেরেছে। মৃত্যুর পরও নায়িকার মরদেহটি পানিতে ভেসে রয়েছে, ডুবছে না। যেহেতু প্রেমের কারণে তার এই মৃত্যু। সুতরাং এই হল- প্রেমের মরা জলে ডুবে না।
এমন সোজাসাপ্টা হিসাবে পাঠক হয়ত হাসছেন। একটু অতীতে ফিরে যান। আপনি ক্লাস থ্রি-ফোরের ছাত্র, বয়স আট-নয়। বন্ধুদের কাছে শুনলেন একটা সিনেমার নাম হল ‘প্রেমের মরা জলে ডুবে না’। আপনার কল্পিত কাহিনিটা নিশ্চয় আমার কাহিনির চেয়ে অতি ভিন্ন কিছু নয়। আবার হতেও পারে।
একটু বড় হয়ে যখন বুঝলাম, মৃত্যুর কারণ যাই হোক- মৃতদেহ পানিতে ডুবে যায়। নিজের ওপর হাসি পেল। অতীতের এমন অনেক কিছুই মানুষকে হাসায়। সময়ের পরিবর্তনে বুঝ-বুদ্ধি-ভাবনায় পরিবর্তন এল। বুঝলাম ‘প্রেমের মরা জলে ডুবে না’ শুনে আমি যে ডোবার (পানিতে ভেসে থাকা) কথা ভেবেছিলাম; নির্মাতা তা বোঝাননি। ওটা তো কৈশরের খেয়ালিপনা। পরিণত ভাবনা নয়। পরিণত ভাবনা হল, মানব-মানবীর জীবন ক্ষণস্থায়ী হলেও প্রকৃত প্রেম চিরস্থায়ী। তাইতো কোন শিল্পী গেয়েছেন ‘এক জীবনে ভালোবেসে ভরবে না মন ভরবে না ...’। মানুষ তার প্রেমকে নিজের জীবনের চেয়ে দীর্ঘ মনে করে বলেই মৃত্যুর পরেও বাকি রাখতে চায় প্রেমের নিদর্শন। যেমন রেখেছেন বাদশাহ শাহজাহান।
বহু দেশের বহু ভাষার অসংখ্য কবি সাহিত্যিক নিজেদের লেখায় প্রেমকে অমর করেছেন। প্রেমের কাছে জীবনটা অতি তুচ্ছ ভেবেছেন। যেমনটা পাওয়া যায় আমার প্রিয় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও রচনায়। বিভিন্নভাবে তিনি দেখিয়েছেন, এই নশ্বর পৃথিবীর সামান্য জীবনে প্রেমাষ্পদকে পাওয়ার পরিবর্তে বরং না পাওয়া এবং না পাওয়া নিশ্চিত জেনেও দূর থেকে ভালোবেসে যাওয়ার মধ্যেই সত্যিকারের সুখ নিহিত। কবি পনের বছরের বিরহ-বিচ্ছেদ বুকে ধারণ করে নার্গিস আসার খানমকে লিখছেন, “আমার অন্তর্যামী জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা! তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না- আমি ধূমকেতুর বিস্ময় হয়ে উদিত হতে পারতাম না।
দেখা ...? না-ই হল এ ধুলির ধরায়। তুমি যদি সত্যিই আমায় ভালোবাস, আমাকে চাও ... ওখানে থেকেই আমাকে পাবে। আত্মহত্যা মহাপাপ। আত্মা অবিনশ্বর, আত্মাকে কেউ হত্যা করতে পারে না। প্রেমের সোনার কাঠির স্পর্শ যদি পেয়ে থাকো ... তাহলে তোমার মতো ভাগ্যবতী কে আছে! তারই মায়াবী স্পর্শে তোমার সকল কিছু আলোয় আলোময় হয়ে উঠবে। মানুষ ইচ্ছে করলে সাধনা দিয়ে, তপস্যা দিয়ে ভুলকে ফুলরূপে ফুটিয়ে তুলতে পারে। যদি কোন ভুল করে থাক জীবনে, এই জীবনেই তার সংশোধন করে যেতে হবে।”
ফজিলাতুন্নেসাকে না পাওয়ার বেদনায় কবি তার প্রিয় বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনকে লিখছেন, “ভাবছি আমার ব্যথার রক্তকে রঙ্গিন খেলা বলে উপহাস যে করেন তিনি হয়ত দেবতা। আমার ব্যথার অশ্রুর বহু ঊর্ধ্বে। কিন্তু আমি মাটির নজরুল হলেও সে দেবতার কাছে অশ্রুর অঞ্জলি আর নিয়ে যাব না।
ফুল ধুলায় ঝরে পড়ে, পায়ে পিষ্ট হয়, তাই বলে কি ফুল এতো অনাদরের? ভুল করে সে ফুল যদি কারুর কবরীতেই খসে পড়ে এবং তিনি যদি সেটাকে উপদ্রব বলে মনে করেন, তাহলে ফুলের পক্ষে প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে এক্ষুণি কারুর পায়ের তলায় পড়ে আত্মহত্যা করা।”
কবির বক্তব্য ব্যাখ্যা করার ধৃষ্টতা দেখাব না। পাঠককে শুধু অনুরোধ করব- ছেলেবেলা থেকে পথে পথে মানুষ হওয়া, বুক কানায় কানায় ভরে ওঠা স্নেহ-প্রেমবঞ্চিত একটি ভাঙ্গা হৃদয় দিয়ে উদ্ধৃতি দুটি বার কয়েক পাঠ করুন।
একজন মানুষ যখন আরো পরিণত হয়। দুনিয়া ও দুনিয়ার বাস্তবতাকে বুঝতে শিখে। ইহ জগত ও জগতের ধোঁকা উপলব্ধি করতে পারে; তখন সে অনুধাবন করে মূলত নশ্বর এ জগতের কোন কিছুই প্রেমাষ্পদ হওয়ার যোগ্য নয়। প্রেমাষ্পদ হওয়ার যোগ্য কেবল অবিনশ্বর কোন সত্তা। অবিনশ্বর সত্তার সাথে প্রেম-সম্পর্ক তৈরি করতে পারলেই অবিনশ্বর আত্মা শান্তি পাবে। তার চাওয়া, পাওয়া হবে। আত্মা খুঁজে পাবে তার প্রকৃত ঠিকানা, সত্যিকার শান্তি। অবিনশ্বর আত্মার অবিনশ্বর প্রেমাষ্পদ সেই মহান সত্তাই হলেন জগতসমূহের স্রষ্টা ও প্রতিপালক মহান রব্বুল আলামিন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন