আরবি ভাষা : ভূত বর্তমান
বাকশক্তি কি কণ্ঠনালী, জিহ্বা, চোয়াল, তালু, দাঁত, ঠোঁট ও নাক এ সপ্তাঙ্গের সাধিত ক্রিয়া? ব্যাকরণ তো তাই বলে! তাহলে নিশ্চয়ই মানবদেহের চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী এ অঙ্গসমূহের অধিকারী প্রাণীকুলের বাকশক্তি তো বহুগুণ শক্তিশালী হওয়ার কথা? ভাবলে- মহান আল্লাহ তা‘আলার অসীম কুদরত ও অপার করুণা নতুনকরে শুকরিয়া আদায়ে উদ্ভুদ্ধ করে তোলে। পৃথিবীর সকল প্রান্ত, সর্ব যুগ, সব মানুষের প্রত্যঙ্গসমূহের কার্যাবলি একই হলেও বাকপ্রত্যঙ্গের কার্য-কথা বহু রকম; সুবহানাল্লাহ। জাতি সংঘের হিসাব মতে- পৃথিবীতে ৭ হাজারের অধিক ভাষা রয়েছে। ভাষাভাষী জনসংখ্যার বিচারে প্রথমে রয়েছে চীনের ম্যান্ডারিন ভাষা (১ বিলিয়ন)। অন্যভাষী মানুষের জন্য শিখতে সহজ-কাঠিন্যতার বিচারেও সবচেয়ে কঠিন ভাষা এই ম্যান্ডারিন। জনসংখ্যার ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে পরবর্তী ৯টি ভাষা- ইংরেজি (৫০৮ মিলিয়ন), হিন্দুস্তানী (৪৯৭ মিলিয়ন), স্পেনিশ (৩৯২ মিলিয়ন), রাশিয়ান (২৭৭ মিলিয়ন), আরবি (২৪৭ মিলিয়ন), বাংলা (২১১ মিলিয়ন), পর্তুগীজ (১৯১ মিলিয়ন), মালেয়ান-ইন্দোনেশিয়ান (১৫৯ মিলিয়ন), ফ্রেন্স (১২৯ মিলিয়ন)।
২৪৭ মিলিয়ন বনি আদমের মুখের ভাষা হিসেবে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার পূর্বে স্থান করে নেওয়া ভাষাটির জন্ম কখন, কোথায় এবং বর্তমান অবস্থান কী? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এ নিবন্ধের প্রতিপাদ্য। মহান আল্লাহই একমাত্র তাওফিকদাতা। মানবসংস্কৃতির প্রারম্ভকাল থেকে শুরু করে লিখিত উপাদান প্রাপ্তির পূর্ব সময়, অন্য কথায়- যে যুগের ইতিহাস নিরূপণে লিখিত কোন উপাদান পাওয়া যায় না সে যুগকে প্রাগৈতিহাসিক যুগ বলে। প্রাগৈতিহাসিক যুগকে স্বীকার করার মধ্যদিয়ে ‘পৃথিবীর শুরু থেকে একটি সময় পর্যন্ত ইতিহাস মানব মাধ্যম তথা পঞ্চইন্দ্রীয় প্রাকৃতিতে বিদ্যমান বস্তুজগতে বিনিয়োগ-সাহায্যে জানা সম্ভব নয়’ এ কথাও স্বীকার করে নেওয়া হয়। এর সমাধানে ধরনা দিতে হয় কুরআন-হাদিসের দরজায়।
ইবনে আব্বাস রাদি.-এর রেওয়ায়েত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তিন কারণে আরবিকে ভালোবাস। আমি আরবি ভাষী। কুরআন আরবি ভাষায়। জান্নাতীদের ভাষা হবে আরবি।” হজরত আবু হোরায়রা রাদি.-এর রেওয়ায়েত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আমি আরবি ভাষী। কুরআন আরবি ভাষায়। জান্নাত অধিবাসীদের কথা হবে আরবি।” আল্লাহ রব্বুল আলামিন হজরত আদম আ.কে জান্নাতে সব জিনিসের নাম তথা ভাষা শিখিয়েছেন। জান্নাতের ভাষা যেহেতু আরবি; সুতরাং তিনি জান্নাতে থাকতে যে ভাষা শিখানো হয়েছে তা অবশ্যই আরবি হওয়া যৌক্তিক। আল্লাহ রব্বুল আলামিনের শিখানো ভাষা ব্যতীত দুনিয়াতে তিনি অন্য ভাষায় কথা বলেছেন; এমনটা ভাবনার সুযোগ কোথায়?
বাইবেল-এর আদি পুস্তক ১১/১ পর্বে আছে, “মানব সৃষ্টির শুরু থেকে হজরত নূহ নবী পর্যন্ত সব মানুষ একই ভাষায় কথা বলত। প্লাবনের পর নূহ আ.-এর পুত্রগণ পৃথিবীর তিন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়লে নতুন নতুন ভাষার সৃষ্টি শুরু হয়।” সংস্কৃত ভাষার ৮০% ক্রিয়ার মূল আরবি। ল্যাটিন ভাষার ৭৫%। এ পরিসংখ্যান থেকেও দাবি করা যায় পৃথিবীর প্রাচীন ভাষা আরবি ভিন্ন নয়।
আরবি ভাষার সাথে বাংলার একটি শক্তিশালী যোগ সূত্র রয়েছে। বাংলা ভাষা সাহিত্যের ছাত্র মাত্রই জানেন, বাংলা ভাষার উৎপত্তি আর্য ভাষা থেকে। ভারতবর্ষের সফল সাহসী ইতিহাসবিদ জনাব গোলাম মর্তুজা সাহেব লিখেছেন, ‘ভারতবর্ষে মুসলমানদের ইতিহাস ঐতিহ্য ধূলিস্যাৎ করার মানসে ইংরেজ গবেষক জনাব ম্যাক্স মুলার সাহেবের মাধ্যমে ব্রিটিশ যে কয়েকটি কাজ করিয়েছে তার অন্যতম ইউরোপ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০-৪০০০ এ আগমনকারী জাতিটি মূলত ‘আরব্য জাতি’। এই আরব্য শব্দের ‘র’কে র-ফলা আর য-ফলাকে ‘য’-এ পরিবর্তন এবং ‘ব’ বর্ণটি ফেলে দিয়ে ম্যাক্স মুলার তৈরি করেছে ‘আর্য জাতি’।’ প্রাচীন ইতিহাসে ইউরোপ শুধু নয় পুরো পৃথিবীতে আর্য নামে যেখানে কোন জাতির অস্তিত্ব নেই সেখানে একটি জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসা কিছু মানুষ ভারতে আসার পর হঠাৎ কোথা থেকে আর্য জাতির উদ্ভব ঘটল? জাতিটি এত অধিক শৌর্য-বীর্যের অধিকারী যে বহিরাগত হয়েও স্থানীয় মানুষের ওপর সকল প্রকার নিয়ন্ত্রণ তারা নিয়ে নেয়। অথচ এ অঞ্চলে আসার পূর্বে যেমন তাদের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায় না; তেমনি বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর তাদের মূল জাতিটিরও কোন নাম-নিশানা পৃথিবীর অন্য কোথাও বিদ্যমান নেই। ম্যাক্স মুলার সাহেব প্রসূত এমন ইতিহাসকে হাস্যকর বলব, না বিস্ময়কর? তারচেয়ে মহাবিস্ময়! এ ইতিহাসটি নির্দ্বিধায় মেনে নিয়ে যুগ যুগ ধরে আমাদের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে পাঠদান করা হচ্ছে এবং জাতি গিলছে। অথচ আমাদের এ বাংলা অঞ্চলেও ১২০৫ থেকে ১৭৫৭ পর্যন্ত শিক্ষার প্রধান বাহন ছিল আরবি।
হজরত ইসমাঈল আলাইহিমুস সালাম আরবি ভাষায় কথা বলতেন; এ ব্যাপারে কোন মতানৈক্য নেই। হজরত আলী রাদি. এক বর্ণনায় বলেন, “স্পষ্ট আরবি আল্লাহ তা‘আলা সর্ব প্রথম হজরত ইসমাঈল আ.কে বলিয়েছেন। তখন তার বয়স ছিল চৌদ্দ বছর।” হজরত নূহ আ.-এর কিশতিতে যারা উঠেছিলেন তাদের একজন ছিলেন ইউরব বিন কাহতান। সে সকলের চেয়ে ভিন্ন এক রকম কথা বলতে শুরু করে। এ ভাষার নাম হয় আরবি। তার বংশধর বনি জুরহাম। এই বনি জুরহাম থেকে ইসমাঈল আ. আরবি ভাষা শিখেন। ইতিহাসবিদগণ এ দাবিও করেছেন।
পৃথিবীর সকল প্রকার জ্ঞানকে প্রধানত তিনটি ভাগ করা যায়। ১. শরিয়ত বা আসমানী জ্ঞান ২. কলা ৩. বিজ্ঞান। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনের পর থেকে সারা বিশ্বের একমাত্র শরিয়ত ইসলাম এবং এ সংক্রান্ত ভাষা আরবি। সভ্যতার শুরু থেকে মধ্যযুগের শেষ পর্যন্ত গণিত, বিজ্ঞান, দর্শনের প্রধান ভাষাও ছিল আরবি। ৮ থেকে ১২ শতক পর্যন্ত সংস্কৃতি, কূটনীতি, বিজ্ঞান, দর্শনের সার্বজনীন ভাষাই ছিল আরবি। ঐ সময় আরিস্তোতল পড়তে চাইলে বা চিকিৎসা বিজ্ঞান, গাণিতিক সমস্যার সমাধান তথা যে কোন প্রকার বুদ্ধিভিত্তিক আলোচনায় অংশ নিতে চাইলে আরবির বিকল্প ছিল না।
বর্তমানে ইউএই, সৌদী, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ইরান, ইসরায়েল, মিসর, জর্ডান, কুয়েত ও ওমানসহ ২৮টি রাষ্ট্রের সরকারি ভাষা আরবি। মাতৃভাষা ২২টি দেশের। আমাদের মাতৃভাষা বাংলার ন্যায় আরবি ভাষায়ও একাধিক উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা বিদ্যমান। কোন কোন উপভাষায় এমন শব্দও রয়েছে যা লিখার জন্য ২৯ হরফের অতিরিক্ত ১-২টি হরফও ব্যবহার করতে দেখা যায়। উপভাষাসমূহের প্রধান প্রধান অঞ্চল বা ভাষার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পার্থক্যের বিবেচনায় নামকরণ করা হয়েছে এভাবে:-
* শাম দেশীয় উপভাষা। ফিলিস্তিন, জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া, তুর্কিস্তান, দ্বীপরাষ্ট্র সাইপ্রাস মিলে মোট ৩৫ মিলিয়ন জনগণ এই শামী উপভাষায় কথা বলে।
* মরক্কোর উপভাষা। উত্তর আফ্রিকার তিউনিসিয়া, লিবিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো মিলে মোট ৯০ মিলিয়ন জনগণ এই মরক্কোর আঞ্চলিক আরবিতে কথা বলে।
* উপসাগরীয় উপভাষা। বাহরাইন, ওমান, কাতার, ডুবাই।
* নজদীয় উপভাষা। সৌদী আরবের মক্কা, মদীনা, বিয়াদ, তাবুক, আলজওফ, আলবাহা, আলকাসিম, আছির, নাজরান, জিজাম, হাইল, পূর্বাঞ্চল প্রদেশ, উত্তর সীমান্ত ১৩টি প্রদেশে এই নজদীয় উপভাষা ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও ইরাকী, ইয়ামেনী, সুদানী, মিসরীয় উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
কুরআন-হাদিস-জান্নাতের ভাষা আরবির বৈশিষ্ট্য বলতে যাওয়া আর দিনের আলোতে সূর্য দেখানো একই কথা। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ গবেষক মো. আবু ইউসুফ বলেন, ‘আরবি পৃথিবীর একটি পরিপূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষা। প্রাচীন ভাষা হিসেবে মানুষের শিক্ষার ভাষা আরবি হওয়াটাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। আরবি ভাষার ন্যায় এত সমৃদ্ধশালী, মোহনীয়, সুমিষ্ট, চিত্তাকর্ষক ভাষা পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। এর প্রাঞ্জলতা, সাবলীলতা, ভাবগাম্ভীর্য, নান্দনিকতা, সৃষ্টিশীলতা সবকিছুই এ ভাষাকে পৃথিবীর অন্যসব ভাষা থেকে স্বতন্ত্র মহিমায় দেদীপ্যমান করে রেখেছে। সুতরাং মর্যাদার দিক থেকে অন্যান্য ভাষার চেয়ে আরবি ভাষার গুরুত্ব অনেক বেশি। এমন মর্যাদাপূর্ণ ভাষার যথাযথ পরিচর্যা ও প্রয়োগ ছাড়া বিশ্বায়ন পরিকল্পনা অবান্তর।’
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন