সনদ নয় পাগড়ি

দারুল উলুম দেওবন্দ ও ঐতিহাসিক ইলহামী এ প্রতিষ্ঠানটির সাথে সম্পৃক্ত ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ বিশ্বের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে থাকা এ ধারার প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা সমাপনীতে “সম্মাননা পাগড়ি” প্রদান করে থাকে। দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার পূর্বকালেও শিক্ষার কোন একটি কোর্স বা মেয়াদ শেষে সার্টিফিকেট-সনদ প্রদানের রীতি চালু ছিল। যৌক্তিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে; সনদ-সার্টিফিকেটের পরিবর্তে পাগড়ি প্রদানের রীতি কেন চালু করা হল? দারুল উলুম দেওবন্দ প্রচলিত রীতির পরিবর্তে একটি নতুন নীতির প্রচলন ঘটানোর যৌক্তিকতা এবং আজকের দিনেও তা ধরে রাখার স্বার্থকতা কী এবং কতটুকু?
দারুল উলুম দেওবন্দ তথা কওমী মাদরাসাসমূহ দীক্ষা নির্ভর প্রতিষ্ঠান। এরা শিক্ষার চেয়ে দীক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এ কারণেই এ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রধানত আবাসিক। প্রতিটি তালিবুল ইলমকে হিংসা, বিদ্বেষ, গিবত, ক্রোধ, লোভ, অহংকার, লৌকিকতা, পরশ্রীকাতরতা, চোঘলখোরী ইত্যাদি আত্মিক কলুষ থেকে মুক্ত করে একেকজন অনন্য মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে নববী আদর্শ-সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন যাপনে অভ্যস্ত-জীবন গঠনে প্রলুব্ধ করে তোলা হয়। এ মহান উদ্দেশ্য সাধনে চব্বিশ ঘণ্টার পুরো সময়টি সুচিন্তিত সূচিছকে বেঁধে দেওয়া হয় এবং পৃথক দায়িত্বপ্রাপ্ত আসাতিযায়ে কেরামের সচেতন দৃষ্টি সীমার মধ্যে থাকতে বাধ্য করা হয়। 
এ বাঁধাধরা নিয়মের মধ্যে থাকাটা বিরক্তির না হয়ে আগ্রহের-অতি আগ্রহের-জীবনের পরম প্রাপ্তির করার জন্য- জীবন ও জগতের বাস্তবতা, সফলতার মূলমন্ত্র, সফলতার শীর্ষে আরোহণকারী বরেণ্য ব্যক্তিদের জীবনী ইত্যাদি প্রতিপাদ্যের পরিপূর্ণ ইসলামী সংস্করণের বই পাঠ ও সাপ্তাহিক/পাক্ষিক সেমিনার-তরবিয়তী মজলিসের আয়োজন করা হয় অতি গুরুত্বের সাথে। মূল ক্ল্যাসিক্যাল-দরসী পাঠ হিসেবে কুরআন-হাদিস তো আছেই। পাশাপাশি আছেন সুন্নাতে নববীর জীবন্তপ্রতীক আদর্শ উসতাযবৃন্দ।  
এসবের দীর্ঘ সান্নিধ্য (১০-১২ বছর) একজন তালিবুল ইলমকে উসওয়ায়ে হাসানাহ-উত্তম চরিত্র, মানবিক সর্বোত্তম গুণাবলির আধার আর পরিপূর্ণ সুন্নাতী জীবনে দীক্ষিত করে তোলে। আর তাই শিক্ষা সমাপনীতে সর্বাধিক মর্যাদাময় অঙ্গ মাথায় টুপির সুন্নাতের উপর পোশাকের আরেকটি সুন্নাত পাগড়ি পরিয়ে দিয়ে এ তালিবুল ইলমের গুরুজনরা সম্মিলিতভাবে যেন বলতে চান- তোমার জীবনে আর কোনদিন একটি মুহূর্তের জন্যও কোন সুন্নাত ছুটে যাবে না।
‘ফে‘লুল হাকিম লা ইয়াখলু আনিল হিকমাতি’- মহা বিশ্বের মহান স্রষ্টা সকল বিজ্ঞজনের জ্ঞানদাতা রব্বুল আলামিনের প্রতিটি কাজ অবশ্যই প্রজ্ঞাপূর্ণ। মানব সৃষ্টির রহস্যও সেই প্রজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। সৃষ্টির প্রকৃত রহস্য স্রষ্টাই জানেন -অন্যরা নয়- এটাই শেষ কথা। আসমানী কিতাব আর নবীগণের মাধ্যমে তিনি যতটুকু জানিয়েছেন, দুর্বল কাঠামো, সীমাবদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী মানব ততটুকুই জানে। ততটুকুই জানতে পারে। ততটুকুই বুঝে। ততটুকুই বুঝতে পারে। 
‘ওমা খালাকতুল জিন্না ওয়াল ইনসা ইল্লা লিইয়া‘বুদুনা আয় লিইয়া‘রিফুনা’- মানুষ তার স্রষ্টা মহান রব্বুল আলামিনের পরিচয় লাভ করবে, মাওলায়ে আজিমের সাথে ভালোবাসা-বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলবে, সুপরিচিত বন্ধুর ভালোবাসায় আবেগতাড়িত হয়ে প্রেমনিবেদনের জন্য তাঁর কুদরতী পায়ে লুটিয়ে পড়বে, তাঁর ইবাদত করবে: মানব সৃষ্টির রহস্য এটাই।
প্রেমের পথ কভু কুসুমাস্তীর্ণ হয় না; হয় কণ্টকাকীর্ণ। নফসের তাড়না, শয়তানের ধোঁকা, ইহুদি-খ্রিস্টানের চক্রান্ত, পরিবেশের অন্ধকারাচ্ছন্নতা এসবই কণ্টকাকীর্ণ পথের একেকটি কাঁটা। এই কাঁটা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে প্রেমাষ্পদের নিকট পৌঁছার পথ বলে দেন, কাঁটা বিঁধে গেলে কাঁটামুক্ত করে ক্ষতস্থানে মলম লাগিয়ে পট্টি বেঁধে দেন, ঘা শুকাবার এন্টিবায়োটিক ও রোগ-রোগীনুযায়ী তা প্রয়োগের সময়-পরিমাণ বলে দেন- ‘তারাই আলউলামাউ ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া’। দীর্ঘ বছর দীক্ষা গ্রহণের তাকমিল-পূর্ণতার পর আজ যে তালিবুল ইলমকে বিদায় জানানো হচ্ছে, সে নবীগণের আসমানী ইলমের উত্তরসূরি আলেম। পূর্বসূরির মিরাসের বাহ্যিক সনদ হিসেবে সম্মিলিত জলসায় সকলের সামনে মাথায় পাগড়ি তুলে দিয়ে যেন তাকে বলে দেওয়া হচ্ছে- পূর্বসূরির আমানত রক্ষা করো। মিরাসের লাজ রেখো। যে মহান ওয়ারাসাত এত দিনে তোমাকে দেওয়া হয়েছে তার ওপরই মাথা বেঁধে দিলাম; যেন অন্য ফিকির প্রবেশের ছিদ্র পথ খুঁজে না পায়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

“সকাল বেলার ধনীরে তুই ফকির সন্ধ্যা বেলা”

দুরুদে সালাত শব্দ থাকা আবশ্যক সালামে থাকবে س ل م

দুটি রহস্যান্মোচন