তাঁর মৃত্যু : আমার মিনতি
এম্বুল্যান্স চলছে। আব্বা মুহ্যমান। চোখে পানি। গলায় কথা সরে না। রেজার দিকে তাকালাম। ও কাঁদছে খুব বেশি। অতীতের জানালায় ভেসে উঠল মাদানীনগরের পরিচয় পর্বটা। কীভাবে মাদানীনগর এলা? উত্তরটা রেজা মুখে দিতে পারেনি, কাগজে দিয়েছিল। আম্মার স্ট্রোক-স্ট্রোক পরবর্তী দিনগুলো পড়ে- অনেক কেঁদেছিলাম সেদিন। নতুন পরিচিত একটা ছেলের মায়ের জন্য কেন এত কাঁদছি? উত্তর জানা ছিল না। না আমার! না তাঁর ছেলের! না কোন মানুষের! উত্তরহীন ঐ কান্না দেখে হয়ত হেসেছিল আসমান? হায়রে অজ্ঞ মানব! তুমি তাঁর জন্য আবার কাঁদবে এম্বুল্যান্সে বসে। সেদিন স্ট্রেচারে ঘুমাবেন শাশুড়ি। পাশের সিটে বসা জামাই খুঁজে পাবে “অজানা-জানা” কান্নার মিল সাত বছর পর।
আব্বা বারবার পেছনে তাকাচ্ছেন। রাসেল ভাই হৃদয়-স্পন্দন বুঝার চেষ্টা করছেন। হায়দার ভাই মৃদুস্বরে মোবাইলে সংবাদ জানাচ্ছেন। নিঃশব্দে পানি ঝরাচ্ছে দশটি চোখ। দুটি চোখ নিমীলিত।
আম্মার অসুস্থতায় আব্বা কোনদিন বিরক্তি প্রকাশ করেননি। চিকিৎসায় অবহেলা করেননি। শরীর ও সাধ্যের সবটুকু চেষ্টা, হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসামিশ্রিত সজাগ-সচেতনতাসহ চিকিৎসা চালিয়েছেন। সুস্থতা-শান্তির জন্য এতটা চেষ্টা-সতর্কতা আম্মার ওপর আব্বার পূর্ণ সন্তুষ্টিরই উজ্জ্বল প্রমাণ। আয় আল্লাহ! আমরা আপনার হাবিবের হাদিস বিশ্বাস করি। এবং বিশ্বাস করি-প্রার্থনা করি-মিনতি জানাই, আপনি আপনার বান্দীর ওপর সন্তুষ্ট। আয় রহমান! আয় রহিম! আমার আম্মা যেন জান্নাতী হন।
আধা ঘণ্টায় আমরা বাসায়। আশপাশের মহিলারা ভিড় জমিয়েছে। এলাকার সাহায্যপ্রার্থিনী মহিলারাও এসেছে। মাত্র পাক করা গরম তরকারি থেকে মাছের মাথাটা উঠিয়ে দান করে দিতেন যে খালা; সেই খালাকে তারা দেখতে এসেছে। দরজায় আসলেই খালা দিতেন। নিজের ইচ্ছেমতো তারা চাইত। খালাও দিতেন সাধ্যমতো। আব্বার অস্থিরতা বেড়ে গেল। আম্মার ব্লাডপ্রেসারর মাপা হচ্ছে বারবার। কোন প্রেসার পাওয়া যাচ্ছে না। মুফতি বোরহান উদ্দিন রব্বানী দা.বা. চোখে টর্চ দিয়ে দেখতে বললেন। আমি দেখে নিশ্চিত হলাম। হাসপাতাল থেকে ডাক্তার দ্বারা মৃত্যু নিশ্চিত করতে বলেছিল। মুখ খুললাম না। ডাক্তার এলেন। সব দেখলেন। নিশ্চিত করলেন। সবাই মনে মনে যা ভাবছিল তাই ঘোষণা হল, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। জুরাইন থেকে এসেই আব্বা কাফন ইত্যাদির জন্য ভাষাণটেক গেলেন। খনন কাজ শুরু হল শেষ বিকেলে, যখন সূর্য ডুবু ডুবু করছে। বাঁশ, পাটি সব প্রস্তুত। চলার শক্তি হারিয়ে ফেলছিলাম বারবার। নোনা পানির সাথে চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাচ্ছিল। সুন্নাত তরিকামতো কবর ও সে অনুযায়ী বাঁশ কাটাতে স্থানীয় লোকদের সাথে ঝগড়া করতে বাধ্য হলাম। আমাদের আইম্মায়ে মাসাজিদ যদি আরও দ্বীনদরদী হতেন! দ্বীনী ব্যাপারে সজাগ-সতর্ক থাকতেন! ...।
গোসল শেষ। জান্নাতের পোশাক হবে সাদা-সবুজ। সে অনুকরণেই বুঝি সাদা পোশাকে রওনা। আম্মার বিদায়ী সৌভাগ্যগুলোর অন্যতম ইহরামের কাপড়ে কাফন। এ বৎসরই আব্বা হজ করেছেন। কাপড়গুলো কিনার সময় দু‘আ করেছিলাম- আয় আল্লাহ! বাইতুল্লাহর জিয়ারত দান করেন। ইহরামের কাপড়ে কাফন নসিব করেন। ইয়া আল্লাহ! আপনার রহমতের কাছে অধম আশা করে, আপনার ঘর-মিনা-আরাফা-মুজদালিফায় “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক” বলা কাপড় পড়া আপনার বান্দীকে আপনি মাফ করে দিয়েছেন। তুলে নিয়েছেন আপন রহমতের কোলে। বিছিয়ে দিয়েছেন জান্নাতের বিছানা। খুলে দিয়েছেন জান্নাতী জানালা। বলেছেন, ঘুমাও বান্দী ঘুমাও। যেভাবে ঘুমায় নবদুলহান। হে আল্লাহ তাই যেন হয়। এ-ই মোদের মিনতি-মুনাজাত-প্রার্থনা।
শেষ বাবেরমতো আম্মাকে দেখার জন্য বাসায় এলাম। চেহারা খুব উজ্জ্বল। যেন হাসছেন। আমি বিশ্বাস করি, নয় বছর দীর্ঘ এ অসুস্থতা নেয়ামত। এ ওসিলায় দয়াময় দাতা, মেহেরবান মাওলা তাঁকে মাফ করে দিয়েছেন। মর্তবা বৃদ্ধি করেছেন। জ্ঞান হারাবার পূর্বে সুন্দরভাবে নামাজ আদায়, ইয়াসিন-মুলক তেলোয়াত, নিয়মিত তাসবিহ, তাওবা, বারবার কালিমা পাঠ- এগুলো তো ক্ষমাপ্রাপ্ত হওয়ারই আলামত। ‘ক্ষমা’। দয়াময়ের এ মহান দান দেখেই বুঝি আম্মা হাসছিলেন। হাসি চেহারাটা দেখে আমার মনও হাসল। কাফনের উপর গড়িয়ে পড়ল দু ফোটা অশ্রু।
বাদ এশা জানাজায় ইমামতি করল রেজা (মাওলানা নাঈম রেজা)। আম্মার আরেক সৌভাগ্য: আপন সন্তান তাঁর জানাজা পড়িয়েছে। জীবনের সর্বশেষ সম্মিলিত এ মাগফিরাত কামনায় ছেলের ‘মিনতি’ যে গভীর হবে; তা তো বড় মাওলানা বা পীর সাহেবের হবে না।
রাসেল ভাই, রেজা, আমি কবরে নামলাম। আস্তে আস্তে আম্মাকে নামালাম। কেবলামুখী করে চির নিদ্রার তরে শুইয়ে দিলাম। বললাম, “বিসমিল্লাহি ওয়া আলা মিল্লাতি রসুলিল্লাহি” (আল্লাহর নামে, রসুলের মিল্লাত তথা তরিকার ওপর তাঁর উম্মত হিসেবে রাখলাম)। কাফনের বাঁধগুলো খুলে দিলাম। একজন একজন উঠে এলাম। এক সময় আম্মা একাই রইলেন। আচ্ছা? আমরা যখন উঠে যাচ্ছিলাম- আম্মা কি আমাদের দেখেছিলেন? ডেকে ডেকে কি বলেছিলেন- জামাই! রাসেল! রেজা! তোমরা আমাকে কোথায় রেখে যাচ্ছ? তোমরা চলে যাচ্ছ কেন? আমার সাথে কে থাকবে? তোমার আব্বা কোথায়? আমি কি একাই থাকব? হ্যাঁ, আম্মা! আপনি একাই থাকবেন। এখানে সবাইকে একাই থাকতে হয়। সবাই যেমন একা দুনিয়াতে আসে তেমন একাই যেতে হয়। কেউ সাথে যায় না। যেতে পারে না। যায় শুধু বান্দার আমল। নেক আমল বেশি হলে, দয়াময় মাওলা দান করলে- এটা “রওজাতুম মিন রিয়াজিল জান্নাহ” (জান্নাতের বাগানসমূহের একটি)।
আম্মা আমরা প্রার্থনা করি, আমি বিশ্বাস করি, আপনাকে আমরা রওজাতুম মিন রিয়াজিল জান্নাহ-এ রেখে গেলাম। আমাদের বিশ্বাস আমলের ওপর নয়। আমাদের ভরসা রহমতে এলাহীর ওপর। যিনি না চাইলেও দান করেন। তাঁর দরবারে রহমতে আমরা করুণ মিনতি জানাই, করি বিনীত ফরিয়াদ- হে খোদা দয়াময়! আমাদের মায়ের কবরখানি যেন রওজাতুম মিন রিয়াজিল জান্নাহ হয়।
আম্মার বেহেশতী বাগানের উপর বাঁশের চাল তৈরি করা হল। উপরে রাখলাম পাটি। তার উপরে দিলাম মাটি। বললাম, “মিনহা খালাকনাকুম ওয়া ফিহা নুয়িদুকুম ওয়া মিনহা নুখরিজুকুম তারতান উখরা” (আমি তোমাদের এ মাটি হতে সৃষ্টি করেছি। এ মাটিতেই ফিরিয়ে আনব। পুনরায় এ মাটি হতেই তোমাদের বের করব)। অনেক মাটি দিয়ে বাগানটাকে জগত থেকে পৃথক করে দেয়া হল। শুরু হল পরজগত। আরম্ভ হয়ে গেল পরকাল। ঘোষণা এল, আমার এই বান্দীর জন্য জান্নাতের বিছানা বিছিয়ে দাও। তাকে জান্নাতী পোশাক পরিয়ে দাও। জান্নাত হতে তার কবরের দিকে জানালা খুলে দাও। তাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও।
বাউনিয়া দক্ষিণ পাড়া (উত্তরা, ঢাকা) বাইতুন নূর জামে মসজিদের উত্তর পাশের কবরস্থানে বাঁশ ঝাড়ের নিচে আম্মা ঘুমিয়ে গেলেন জান্নাতী ঘুম। (লেখাটি ৩১ মে ২০০৯, রবিবার। লেখকের দিনলিপির সংক্ষেপ)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন