অজ্ঞতার প্রমাণ দিতে হয় না
আবহমান কাল হতে চলমান এ ধরণীতে প্রাণীজগতের বংশ বিস্তার পৃথিবী সচলতারই একটি অংশ। কত শত সহস্র বছর ধরে প্রাণীকুলের এ পরম্পরা চলমান তার সঠিক হিসাব জানেন শুধু আল্লাহ তা‘আলা। আর কতকাল চলবে তাও জানেন তিনিই। মানবীয় গণনাশক্তির ঊর্ধ্বে প্রাণীকুলের তালিকায় সর্বোচ্চ-সর্বোন্নত স্থান অধিকারী অনন্য সৃষ্টি ইনসান বা মানুষ। ইনসানের অনন্যতার একটি বৈশিষ্ট্য বংশধারা সংরক্ষণ। ভিন্ন কথায়, পিতৃ-পরিচয়। পিতৃ-পরিচয়ের এ নেয়ামত মহান রাব্বুল আলামিন জিন ও ইনসান ব্যতীত তৃতীয় কোন সৃষ্টিকে দান করেননি। এর যথাযথ শুকরিয়ার পদ্ধতি হিসেবেই দান করেছেন বিবাহ ও বৈবাহিক জীবনের বিধান। একজন মানব ও মানবী কতক শর্তের ভিত্তিতে পরস্পরের সম্মতিতে একটি জীবনে অঙ্গীভুত হওয়াই বিবাহ।
জীবনধারা, রুচি-সংস্কৃতি, চিন্তা-ভাবনা, চালচলন, পোশাকআশাক, খাদ্যাভ্যাসÑ এসবের সামঞ্জস্যতা ঐ অঙ্গীভুত জীবনের নিগুঢ় রহস্য। উভয়ের চিন্তার মেরু যদি এক না হয়, ভাবনার গতি যদি সমান্তরাল না হয়- তবেই দেখা দেয় বিভাজন। বিভাজন-অগ্নিতে পানির পরিবর্তে বাতাস লাগলে, লাগতেই থাকলে অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে অযাচিত, অনাকাঙ্ক্ষিত, আল্লাহ ও রাসুলের দৃষ্টিতে ঘৃণিত; তবে অনুমোদিত বিয়োজন। এ অগত্যা বিয়োজনের খোদায়ী পদ্ধতির নাম খোলা বা তালাক।
“মানুষের মন বড় বিচিত্র” প্রবাদটি স্মরণ করা যেতে পারে। বহু বৈচিত্র্যের সমাহার যদি হয় মন; মননে পরিবর্তন তাহলে বিচিত্র কিছু নয়। অথবা বলুন, চিন্তার মেরু এক থাকলেও কখনো তা পাল্টে যেতে পারে। ভাবনার গতি সদা সমান্তরাল নাও থাকতে পারে। এ পাল্টে যাওয়া যদি আর ঠিক না হয়, অসমান্তরালকে পুনরায় সমরেখায় আনা সম্ভব না হয়- তখনই প্রয়োজন বিয়োজন বা স্বাধীন হওয়ার। প্রয়োজন খোলা বা তালাকের।
এ স্বাধীনতা কেবল স্বাধীনতা নয়; স্বাধীনতার রঙ্গিন মোড়কে লুকানো অনিশ্চিত আগামীর অথৈ সাগরে পাড়ি জমানোর লক্ষ্যে নৌযানবিহিন বেরিয়ে পড়া। সহযাত্রী ও পাথেয়বিনা অচিনপুরের পথে পথচলা। এমন কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে ভাবনার, বারবার যাচাই করবার প্রয়োজন রয়েছে নিশ্চয়। এতো এমন এক সিদ্ধান্ত- যেখানে সঠিক সিদ্ধান্তও দুঃখের। যার সুন্দর সমাপ্তিও বেদনার। সিদ্ধান্ত যদি হয় ভুল, যদি পদক্ষেপ হয় অসুন্দরের, যদি সৃষ্টি হয় বিশৃঙ্খলার তবে তো আর দুঃখ ও বেদনার কোন সীমা-পরিসীমা থাকবে না। সুতরাং কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব অবশ্যই কঠিনপ্রাণ, অধিক বিবেচনা শক্তির অধিকারী, জগতের কঠোর বাস্তবতায় বারবার নিজেকে যাচাই করে সিদ্ধহস্ত ব্যক্তির ওপরই বর্তানো উচিত। পৃথিবী নামক এ গ্রহে বসবাসকারী, সুস্থ মস্তিষ্কের ধারক, বিবেকবান যে কোন মানুষই স্বীকার করবেন- “কঠিনপ্রাণ, অধিক বিবেচনা শক্তি ও বাস্তবতা পরখে সিদ্ধহস্ত” গুণত্রয় প্রাকৃতিক নিয়মেই স্ত্রীর চেয়ে স্বামীকে অনেক বেশি দান করা হয়েছে। তাই সার্বিক বিচারেই ঐ অগত্যা বিয়োজন-চিন্তার ভারও স্বামীর কঁধেই ন্যাস্ত করা বিচক্ষণতার দাবি। তাইতো মহান রাব্বুল আলামিন স্পর্শকাতর, ঝুঁকিপূর্ণ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তালাকের বিষয়টি স্বামীর কাঁধেই ন্যাস্ত করেছেন। খোদায়ী সেই বিধান উপেক্ষা করে আমরা নারীকে তালাকের অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছি। এর পরিণতি ভাবার জন্যে গত ২৭ মার্চ ২০১৭ বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর একটি রিপোর্টের অংশ উদ্ধার করছি :-“ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন দুই এলাকাতেই নারীরা বিবাহবিচ্ছেদের জন্য পুরুষের চেয়ে বেশি আবেদন করছেন। এক জরিপে দেখা যায়, বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করছেন ৭০ দশমিক ৮৫ ভাগ নারী। অন্যদিকে পুরুষের এ হার ২৯ দশমিক ১৫ ভাগ। আর শিক্ষিত কর্মজীবী নারীরা এ ক্ষেত্রে বেশি আবেদন করছেন। তবে বিচ্ছেদের জন্য নিম্নবিত্ত ও উচ্চবিত্ত উভয় শ্রেণির নারীরাই আবেদন করছেন। শালিসি পরিষদে সাধারণত বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে বনিবনা না হওয়া এবং স্বামী কর্তৃক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কথা উল্লেখ করা হলেও এগুলো যথাযথ কারণ বলে মনে করে না এর সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট মহল। তাদের মতে, আগে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা মেয়েকে নিরুৎসাহিত করলেও এখন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ায় তারা আর তাকে বোঝা বলে মনে করেন না। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় তালাকের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫২ হাজার। আর প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ৬০টির মতো বিচ্ছেদের আবেদন জমা হচ্ছে এই সেবা সংস্থায়। শুধু রাজধানীতে বর্তমানে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে ৪৯ হাজার বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন। আর বিচ্ছেদের ঘটনা বিগত বছরগুলোয় বৃদ্ধি পাওয়ায় শালিসি বোর্ডের কর্মকর্তাদেরও এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে। রাজধানীর গত পাঁচ বছরের বিবাহবিচ্ছেদ-সংক্রান্ত শালিসি পরিষদের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রায় ৩৪ হাজার তালাকের নোটিসের মধ্যে স্ত্রীর পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে ২৩ হাজার আর স্বামীর পক্ষ থেকে ১১ হাজার। দুই সিটি করপোরেশনের ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পাঁচ বছরে রাজধানীতে তালাকের মোট আবেদনের ৬৬ দশমিক ১৬ শতাংশ স্ত্রীর এবং ৩৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ স্বামীর পক্ষ থেকে করা হয়েছে। এ সময় বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে ২৫ হাজার ৯৬৯টি। এ হিসাবে প্রতি বছর ৮ হাজার ৮২৮টি, মাসে ৭৩৬টি এবং দিনে ২৫টি সংসার ভাঙছে।
এই সময়ে উত্তরে ১৮ হাজার ২২০টি তালাকের নোটিস জমা পড়েছে, যার মধ্যে পুরুষের পক্ষ থেকে ৬ হাজার ৯২৯টি এবং নারীর পক্ষ থেকে ১১ হাজার ৬৯২টি নোটিস জমা পড়ে। এর মধ্যে নোটিস কার্যকর হয়েছে ১৪ হাজার ৫৮টি। উত্তরের পাঁচটি অঞ্চলের গত পাঁচ বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া যায়। এ ছাড়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বিচ্ছেদের নোটিস পড়েছে ১৪ হাজার ১৭৫টি। এর মধ্যে পুরুষের পক্ষ থেকে জমা পড়েছে ৪ সহ¯্রাধিক আর নারীর পক্ষ থেকে ৯ হাজার ৬৮৩টি। নোটিস কার্যকর হয়েছে ১১ হাজার ৯১১টি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-১-এর কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সমাজের সব শ্রেণির নারী বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আবেদন করছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্ত নারীদের কেউ কেউ বিবাহবহির্ভুত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েও বিচ্ছেদ চাইছেন বলে তারা মন্তব্য করেন। উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৩-এর নির্বাহী কর্মকর্তা জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শালিসি পরিষদ হিসেবে আমাদের আসলে কিছু করার থাকে না। মাত্র ২ শতাংশ দম্পতি আমাদের কাছে শালিস বৈঠকে আসেন।’ তিনি বলেন, নারীদের তালাক দেওয়ার হার পুরুষের চেয়ে অবশ্যই বেশি।”
বোদ্ধা পাঠকমহলের জন্য একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল থেকে ছোট্ট একটি কপি-পেস্ট:- “বিকারগ্রস্ত মানুষ সব সময় ছিল এখনও আছে। সময়ের প্রয়োজন ও প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এসব মানুষ বাড়ছে বৈ কমছে না। বিকারগ্রস্ত সমাজের একটি বড় ব্যাধি হলো ডিভোর্স। সামান্য থেকে সামান্যতম কারণে একটি সাজানো সংসার ভেঙ্গে খান খান। অতি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে ডিভোর্সের হার। ঢাকার একটি প্রভাবশালী দৈনিকের পক্ষ থেকে ডির্ভোসের প্রবণতা নিয়ে পরিচালিত এক জরিপে উঠে এসেছে এরকম চাঞ্চল্যকর তথ্য। সেই জরিপের ভিত্তিতে দেখা যায়, অধিকাংশ ডিভোর্সের ঘটনা ঘটছে মেয়েদের পক্ষ থেকে। শতকরা ৬৬ ভাগ ডিভোর্সই দেওয়া হচ্ছে স্ত্রীদের পক্ষ থেকে। ডিভোর্সের ঘটনা বেশি ঘটছে উচ্চবিত্ত ও নি¤œবিত্ত পরিবারে। ... নারীরা কেন অত সহজেই ডিভোর্স দিয়ে একটি সাজানো সংসারকে ভেঙ্গে খান খান করে দিচ্ছেন বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করলে বেরিয়ে আসে নানা তথ্য। আশ্চর্যের বিষয় হলো এর অধিকাংশই ধর্ম পালন ও নৈতিকতার চর্চার সঙ্গে জড়িত। যে সব পরিবারে ধর্ম ও নৈতিকতার চর্চা কম হয় সেখানেই এ ধরনের বিপত্তি বেশি ঘটে বলে গবেষণায় বেরিয়ে আসে।”
ইসলাম পুরুষকে তালাকের ক্ষমতা দিয়েছে; নারীকে কিছুই দেয়নি বিষয়টি এমন নয়। বরং বাস্তবিকই যদি পুরুষের পক্ষ থেকে নির্যাতন হতে থাকে, স্ত্রী যদি নৈরাশ হয়ে পড়েন- প্রয়োজনে তিনিও বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোর উদ্যোগ নিতে পারেন। মনে রাখতে হবে, “কঠিনপ্রাণ, অধিক বিবেচনা শক্তি ও বাস্তবতা পরখে সিদ্ধহস্ত” গুণত্রয় প্রাকৃতিক নিয়মেই স্ত্রীর চেয়ে স্বামীকে অনেক বেশি দান করা হয়েছে। তাই ঐ অগত্যা বিয়োজন-চিন্তা যদি স্ত্রীকে করতেই হয়- তা একাকিনী করার অধিকার দেওয়া যে চরম মূর্খতা, ঋদ্ধ পাঠকবর্গের নিকট তা বিশ্লেষণ করতে যাওয়া বাতুলতা। অতএব, চিন্তা-শক্তি-শূন্য কতক মস্তিষ্কে না খেললেও জ্ঞানীরা ঠিকই বুঝেন, স্ত্রী বিবাহ বিচ্ছেদের উদ্যোগ নিলেও তা যেন সাথে সাথে কার্যকর না হয়; বরং বুঝ-বিবেচনা, বিচার-বিশ্লেষণের সুযোগ থাকে। বুঝ-বিবেচনা, বিচার-বিশ্লেষণের সুযোগসমৃদ্ধ স্ত্রীকর্তৃক বিবাহ বিচ্ছেদের খোদায়ী বিধানের নাম ‘খোলা’। প্রচলিত ডিভোর্সের পক্ষে যারা শ্লোগান তোলেন অথবা তালাকের একক অধিকার স্বামীর কেন হবে:- এমন প্রলাপ বকেন; তারা কি বুঝেন যে, এসব চেঁচামেচি সৃষ্টিকর্তাকর্তৃক সৃষ্টির জন্য বৈধকৃত খোলা ও তালাকের প্রকৃত বিধান সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতার প্রমাণ বৈ অন্য কিছু নয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন