ঘুরে এলাম চিড়িয়াখানা

১৬ মার্চ ২০১১। বুধবার। মা! আমরা আজ চিড়িয়াখানায় গিয়েছি। তুমি, তোমার মা, আমি। সাথে আছেন তোমার মোস্তফা চাচ্চু, চাচী, রাইসা আপু। চিড়িয়াখানা শব্দটি দুটি শব্দের সন্ধিতে তৈরি। উর্দু ভাষায় ছোট পাখিকে বলে ‘চিড়িয়া’ আর খাঁচা/ঘর বোঝাতে উর্দুতে ব্যবহার হয় ‘খানা’। সে মতে চিড়িয়াখানা অর্থ ছোট পাখির খাঁচা। তবে এখন আর সন্ধিপূর্ব এ অর্থ আমরা বোঝাই না। বর্তমান ব্যবহারে চিড়িয়াখানার অর্থ পশু-পক্ষিশালা। সংজ্ঞায়িত করতে চাইলে বলা যায়- পশু, পাখি, সরীসৃপ প্রভৃতির দর্শনীয়ভাবে সংরক্ষণের স্থানকে বলে চিড়িয়াখানা।
তুমি তোমার চাচ্চুর কোলে গেলা। তোমাকে এই প্রথম দেখলেন। ‘আওয়াজ বাণিজ্যের ব্যস্ততায় তিনি কাতারে থাকেন। তোমাকে দেখার জন্য আমার কাছে ছবি চেয়েছেন বারবার। কিন্তু মা ছবি তোলা একটি গুনাহের কাজ। আজ পর্যন্ত আমরা তোমার কোন ছবি তুলি নাই। তোমার আব্বু আম্মুও ছবি তোলে না। জরুরি প্রয়োজনে অর্ধছবি ছাড়া জীবনে কোন ছবি তুলবে না। প্রিন্ট হোক বা না হোক, চাই সেটা মোবাইল ক্যামেরা হোক- তুলবে না, এটাই কথা। আয় আল্লাহ, সেই প্রয়োজনটা যেন হয় আমাদের বাইতুল্লাহর সফর।
বানরদের বাদাম খাইয়ে এগিয়ে গেলাম হরিণের খাঁচার দিকে। অনেক বড় খাঁচা। সে তুলনায় খাঁচাধিবাসী অনেক কম। যতটুকু মনে পড়ে, ছোট বেলায় যতবার এসেছি অনেক হরিণ ছিল। খাঁচা ঘেঁষে একটা হরিণী বসা। তোমাকে ধরালাম। গায়ে হাত দিয়ে সে তোমার কি যে খুশি মা! তা কি আর লিখা যায়? সামনে এগিয়ে একটু নিচুতে বাঘের খাঁচা। একটায় বাঘ আছে। আরেকটা খালি। মা, তুমি তো হরিণীর মতো বাঘও ধরতে চাচ্ছ। ভাবছ প্রয়োজনে ভিতরে যেয়ে আদর করে আসবে। জিজ্ঞেস করলাম ভিতরে যাবে? মাথা নেড়ে বললা হু...। হরিণ আর বাঘ তোমার কাছে একই ব্যাপার। তুমি ছোট। আকৃতি কিছুটা এক হলেও উভয়টার চরিত্রের আকাশ-পাতাল ব্যবধান তুমি বুঝ না। জান্নাত-জাহান্নামের ব্যবধানটাও এরূপ। হরিণ-বাঘের মতো। কিন্তু আমরা অনেক সময় নফস-শয়তান-পরিবেশের ধোঁকায় ভুলে যাই। বাঘের গায়ে আদর দিতে চাই। সামনে আগালে সিংহের খাঁচা। গোস্ত খাচ্ছে। লোকের ভিড়। তোমাকে কাঁধে উঠিয়ে দেখালাম। ফিরে আসছি। হঠাৎ শুরু হল সিংহের গর্জন। ‘খাঁচায় বন্দি’ যদি সুনিশ্চিত জানা না থাকত; আরো সাহসী মানুষও ভয় পেত নিশ্চিত। তারপরও কেউ ভয় পায়নি বলা মুশকিল। ছোট বেলায় কখনও সিংহ-গর্জন শুনেছি কি-না মনে নেই। আমি যাদের সাথে গিয়েছিলাম তারা কেউ আমার জন্য লিখেও রাখেনি।
পাশের পুকুরে রাজাহাঁস ছিল। একে একে বিভিন্ন জাতের বানর, অন্যান্য পশু, পাখি, দেখতে দেখতে এগিয়ে গেলাম ময়ূর-খাঁচার দিকে। আমি তখন স্কুলে পড়ি। আকাশে মেঘ জমল। লোকে বলাবলি করল, ময়ূর এখন পেখম মেলবে। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। কিন্তু মেলল না। আজ তুমি পেখমমেলা তিনটি ময়ূর দেখেছ। একটি সাদা ময়ূরও। এত সুন্দর করে আল্লাহ তাদের বানিয়েছেন! দুনিয়ার ময়ূর যদি হয় এত সুন্দর! জান্নাতের ময়ূর তাহলে কত সুন্দর! জান্নাত কত সুন্দর!! সে সুন্দর তো দুনিয়ার কোন চোখ দেখেনি। কোন কান শুনেনি। কোন অন্তর কল্পনাও করতে পারেনি। মা, কাগজ-কলম নিয়ে সব প্রাণীর একটা পূর্ণাঙ্গ তালিকা করে আনলে ভাল হত। হয় নাই। তুমি যখন লিখতে জানবে, আমরা আবার যাব, ইন শা’ আল্লাহ। তুমিই পূর্ণ করবে তোমার আব্বুর অপূর্ণ কাজ।  
জোহর আদায় করে ভিতরেই একটা দোকান পেলাম। সামনের খালি জায়গায় গাছের নিচে বসে খাচ্ছি। পাশে কয়েকটা কাক। এ লাইনটা লিখছি সময় দূরে একটা কাক ডাকাডাকি করছে। কাকের সাথে তোমার একটা পূর্ব সম্পর্ক আছে। একটা অসুস্থ কাকের মাথায় পানি ঢালতে দেখা এবং পরে অনেক দিন বিভিন্ন ভঙ্গিতে পানি ঢালার গল্প বলা। আমাদের ছয়জনের সাথে ওরাও কয়েকজন শরিক হল। মিলেমিশে নাস্তা করলাম। তবে ওদের সামান্যই দিয়েছি। নিজেরা খেয়েছি বেশি। এই স্বার্থপরতা মুক্ত হতে পারব কি-না জানি না? “শারীরিক আহারে উভয় প্রাণের সমান ভাগ” যেদিন অন্তর থেকে এমনটা ভাবতে পারব সেদিন আমরা হতে পারব “অনন্য মানুষ”। 
মা! এখানে এসে যদি প্রশ্ন করি, আমি তোমাকে কেমন দেখতে চাই? আমার বিশ্বাস, তুমি বলবে- “একজন অনন্য মানুষ” হিসেবে। তুমি যেদিন “অনন্য মানুষ” সেদিন আমি কি হায়াতে না মামাতে? মা’রে, তোকে যে কতকিছু বলতে মনে চায়! বারবার কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছি? “অনন্য মানুষ” শব্দ দু’টোর সাথে আমার বড় বড় দু’টো দুঃখ আছে। সব কথা সব সময় বলতে নেই। অনেক সময় লিখতে পারার চেয়ে না লিখা কঠিন হয়ে ওঠে। এই কঠিন কাজটা করতে পারাও “অনন্য” হওয়ার একটা পদক্ষেপ। 
অন্য দু’টি বাঘের খাঁচা পেলাম। একটা হুংকার ছাড়ল। সিংহের মতো কর্কশ নয়। এরপর পেলাম উটপাখি। এ এক আজব প্রাণী। আকারে তো বড় একটা গরুর চেয়ে ছোট বলা যায় না। আবার দু’টো ডানাও আছে পুরো পাখির মতো। যদিও ঐ ডানা দিয়ে কোনদিন উড়েনি। ফরিদ উদ্দীন আত্তার রহ. লিখেছেন, হে বৎস! তুমি উটপাখির ন্যায় হইও না। উটপাখি তো ডানার বাহানায় বোঝা বহন করে না। ‘উট’ নামধারণ করে আবার আকাশেও উড়ে না। অর্থাৎ অলসের বাহানা অনেক। কাজের লোক বাহানা তালাশ করে না। পরিস্থিতি-প্রতিকুলতার নিকট হার মানে না। বাবা হিসেবে তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি, পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুকুলে এলে কাজ করবে: এ অপেক্ষায় থাকবে না। মনে রাখবে, পরিবেশ আসমান থেকে নেমে আসে না। কেউ কাউকে পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দেয় না। পরিবেশ নিজেই তৈরি করে নিতে হয়। পরিস্থিতি নিজেই সৃষ্টি করতে হয়।
উটপাখির পর জিরাফ, জেব্রা, কয়েক প্রকার বিদেশী গরু দেখে হাতির কাছে আসি। তোমাকে নিয়ে হাতিতে চড়লাম। কান্না থামাতে আবারও চড়তে হল। ঐ অতটুকুন তুমি হাতিতে চড়ার এত স্বাদ কীভাবে পেলা! আমরা খু-উ-ব অবাক হয়েছিলাম। বের হওয়ার পথে প্রাণী যাদুঘর, কুমির, গণ্ডার আর যেন কী। সর্বশেষ তোমার ও রাইসা আপুর জন্য বেলুন। 
আল্লাহর এতসব সৃষ্টি দেখে তাঁর বিশালতা নিয়ে চিন্তা করবে। আপন ক্ষুদ্রতার পূর্ণ অনুভূতি নিয়ে লুটিয়ে পড়বে মহান মাওলার কুদরতী পায়ে। এই আমার আশা। বিদায় চিড়িয়া, বিদায় খানা। 
( লেখকের দেড় বছর বয়সী মেয়েকে চিড়িয়াখানা দেখাতে নিয়ে যাওয়ার দিনপঞ্জী।) 

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

“সকাল বেলার ধনীরে তুই ফকির সন্ধ্যা বেলা”

দুরুদে সালাত শব্দ থাকা আবশ্যক সালামে থাকবে س ل م

দুটি রহস্যান্মোচন